Home LATEST NEWS bangla সর্বশেষ সংবাদ নিজ্জর হত্যাকাণ্ডে কানাডায় গ্রেফতার হওয়া তিন ভারতীয় যুবকের পরিবার কী বলছে?

নিজ্জর হত্যাকাণ্ডে কানাডায় গ্রেফতার হওয়া তিন ভারতীয় যুবকের পরিবার কী বলছে?

2
0

Source : BBC NEWS

নিজ্জর হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে কানাডায় তিন যুবককে গ্রেফতার করা হয়েছে।

ছবির উৎস, RCMP

শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হরদীপ সিং নিজ্জরকে হত্যার ঘটনায় তিন ভারতীয়কে গ্রেফতার করেছে কানাডার পুলিশ।

গত বছর ১৮ই জুন হরদীপ সিং নিজ্জরকে একটা গুরুদ্বারের পার্কিং লটে আততায়ীরা গুলি করে হত্যা করে বলে অভিযোগ। কানাডার ভ্যাঙ্কুভারে গুরু নানক শিখ গুরুদ্বারের সভাপতিও ছিলেন মি. নিজ্জর। এই হত্যার ঘটনায় গত সপ্তাহের তেসরা মে তিনজন ভারতীয় অভিযুক্তকে গ্রেফতার করেছে কানাডার ‘ইন্টিগ্রেটেড হোমিসাইড ইনভেস্টিগেশন টিম’

গ্রেফতারকৃতরা হলেন করণ ব্রার, করণপ্রীত সিং ও কমলপ্রীত সিং।

বিবিসি পাঞ্জাবী এই তিন যুবকের পারিবারের বিষয়ে এবং অন্যান্য তথ্য জানার চেষ্টা করেছে।

আরও পড়তে পারেন:
বাঁদিক থেকে ডানদিকে: করণপ্রীত সিং, করণ ব্রার ও কমলপ্রীত সিং।

ছবির উৎস, RCMP HANDOUT

পাঞ্জাবের বাসিন্দা তিন যুবক

হরদীপ সিং নিজ্জরের হত্যাকাণ্ডে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ‘ভারত সরকারের এজেন্টদের’ জড়িত থাকার অভিযোগ করেছিলেন।

২০২৩ সালে কানাডার পার্লামেন্টে এই অভিযোগ করেন তিনি। তবে ভারত সরকার এই সমস্ত অভিযোগকে ‘ভিত্তিহীন’ বলে জানিয়েছিল।

এই মামলায় সম্প্রতি যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের মধ্যে বছর বাইশের করণ ব্রার পাঞ্জাবের ফরিদকোটের বাসিন্দা। করণপ্রীত সিংয়ের বাড়ি গুরুদাসপুরে এবং তৃতীয় অভিযুক্ত কমলপ্রীত সিং জলন্ধর জেলার বাসিন্দা।

স্টাডি পারমিট নিয়ে কানাডায় গিয়েছিলেন করণ ব্রার। পাঞ্জাব পুলিশের সূত্র অনুযায়ী, ফরিদকোট জেলার কোটকপুরা শহরের কোট সুখিয়া গ্রামে তাদের বাড়ি। করণ ব্রার কোটকাপুরায় স্কুলে পড়াশোনা শেষ করে ২০২০ সালে স্টাডি পারমিট নিয়ে কানাডায় যান বলেও জানা গিয়েছে।

জমিদার পরিবারের সন্তান তিনি। প্রতিবেশী এবং এলাকাবাসীদের থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, করণ ব্রারের দাদু বলবীর সিং ব্রার স্থানীয় ব্যবসায়ী।

বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে করণ ব্রার।

পরিচিতরা জানিয়েছেন, তার মা রমণ ব্রার কাজের সূত্রে সিঙ্গাপুরে থাকতেন। গত মাসের ১৮ই এপ্রিল করণ ব্রারের বাবা মনদীপ ব্রারের মৃত্যু হয়। এরপর তার মা ভারতে ফিরে আসেন।

শনিবার বিবিসি টিম গিয়ে দেখে করণ ব্রারের বাড়ি তালাবদ্ধ।

ছবির উৎস, X/VIRSA SINGH VALTOHA

করণ ব্রারের কোনও পূর্ব অপরাধের রেকর্ড নেই

এই যুবকের পূর্ব অপরাধের কোনও রেকর্ড নেই।

ফরিদকোটের পুলিশ সুপার জসমিত সিং জানিয়েছেন, আগে কোনও অপরাধজনিত কাজে জড়িত থাকার রেকর্ড করণ ব্রারের নেই।

তবে করণের বাবার বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা দায়ের করা হয়েছিল। বিবিসি পাঞ্জাবীর হাতে আসা এফআইআর অনুযায়ী, করণ ব্রারের বাবা মনদীপ সিং ব্রারের বিরুদ্ধে ফরিদকোট জেলায় প্রতারণার একটি অভিযোগ রয়েছে।

২০২৪ সালের পহেলা এপ্রিল কোটপুরা থানায় ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪২০ ধারায় তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছিল।

রবীন্দ্রপাল সিং নামে এক ব্যক্তির অভিযোগের ভিত্তিতে ফরিদকোট জেলার কোটকাপুরা থানায় মনদীপ সিংয়ের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করা হয়।

দায়ের করা এফআইআরে রবীন্দ্রপাল সিং অভিযোগ করেছিলেন ২০১৮ সালে কানাডার ভিসা পাওয়ার জন্য তিনি মনদীপ সিংকে আড়াই লক্ষ টাকা দেন। যদিও তিনি ভিসা বা টাকা কোনওটাই ফেরত পাননি।

করণপ্রীত সিংয়ের আত্মীয় স্বজন।

গুরুদাসপুরের করণপ্রীত সিং

গুরুদাসপুর থেকে বিবিসির সংবাদদাতা গুরপ্রীত সিং চাওলা জানিয়েছেন, করণপ্রীত সিং গুরুদাসপুর জেলার সুন্দাল গ্রামের বাসিন্দা।

এক কৃষক পরিবারের ছেলে মি. সিং। তার বাবা দুবাইয়ে ট্রাক চালান।

গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধানের ছেলে রঞ্জিত সিং রানা সম্পর্কে করণপ্রীতের কাকা হন। রঞ্জিত সিং রানা জানিয়েছেন, করণপ্রীত সিং সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বেড়ে ওঠাও সেখানেই।

প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেই ২০১৬ সালে করণপ্রীত দুবাই চলে যান। যেখানে তিনি বাবার সঙ্গে প্রায় চার বছর ট্রাক চালক হিসাবে কাজ করেন।

রঞ্জিত সিং রানা জানিয়েছেন করণপ্রীত সিং ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে কানাডায় গিয়েছিলেন। গত তিন বছর ধরে কানাডাতে থাকতেন। সেখানেও তিনি ট্রাক চালাতেন।

তার কথায়, “করণপ্রীতের এখানে কোনও অপরাধের রেকর্ড নেই। বরং খুবই মিশুকে প্রকৃতির ছেলে। তাই ওর গ্রেফতার হওয়ার ঘটনায় গ্রামবাসীরা বেশ অবাকই হয়েছেন,” বলেছেন রঞ্জিত সিং।

করণপ্রীত সিংয়ের গ্রামের ছবি।

“গ্রামের কাছের একটি স্কুল থেকে পড়াশোনা শেষ করেছে করণপ্রীত। পাঞ্জাবে থাকাকালীন কিন্তু ওর কোনওরকম অপরাধমূলক কার্যকলাপে জড়িত থাকার কোনও তথ্য নেই।”

করণপ্রীত সিংয়ের পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, তারা বিশ্বাসই করতে পারছেন না যে তাদের বাড়ির ছেলে এমন অপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে।

করণপ্রীতের দুই বোন আছে। দু’জনেই বিবাহিত। গ্রামবাসীরা জানিয়েছেন, প্রায় দু’দিন আগে বাড়ির লোকের সঙ্গে কথা হয়েছিল তার। আর পাঁচটা দিনের মতোই কথাবার্তা হয়েছিল তাদের মধ্যে।

করণপ্রীত সিংয়ের স্বজনেরা জানিয়েছেন , টাকা ধার করে করণপ্রীতকে কানাডায় পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিল তার পরিবার।

এছাড়া তার সম্পর্কে আর কোনও তথ্য জানাতে রাজি হননি তারা।

স্টাডি ভিসায় কানাডায় পাড়ি কমলপ্রীত সিংয়ের

ধৃতদের মধ্যে জলন্ধর জেলার নাকোদার মহকুমার চক কলা গ্রামের বাসিন্দা কমলপ্রীত সিংও রয়েছেন।

নকোদরের এক বেসরকারি স্কুলে পড়াশোনা করেছেন কমলপ্রীত সিং । ২০১৯ সালে দ্বাদশ শ্রেণি পাশ করার পর কানাডায় চলে যান স্টাডি ভিসায়।

কমলপ্রীত সিংয়ের পরিবার আর্থিকভাবে স্বচ্ছল। তার বাবা সতনাম সিং চাকরি করেন। গ্রামে তাদের বেশ জমিজমাও রয়েছে।

পাঞ্জাব পুলিশের এক আধিকারিক জানিয়েছেন, তার (কমলপ্রীতের) বোনও কানাডায় থাকেন। ২০২২ সালে কানাডায় তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন কমলপ্রীত মা।

জলন্ধর রুরালের সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা অঙ্কুর গুপ্তা বিবিসিকে ফোনে বলেছেন, “আমরা যতদূর তদন্ত করে আমরা জানতে পেরেছি, জলন্ধর জেলায় কমলপ্রীত সিংয়ের কোনও অপরাধমূলক রেকর্ড নেই।

কমলপ্রীতের বাবা সতনাম সিং বিবিসি পাঞ্জাবীকে বলছিলেন, “আমার ছেলের গ্রেফতারের কথা আমরা সংবাদমাধ্যম থেকে জানতে পারি। এটা আমাদের জন্য খু্বই দুঃখজনক।”

“২০১৯ সালে স্টাডি ভিসায় কানাডায় গিয়েছিলেন কমলপ্রীত। গত দুই বছর ধরে গুরুদাসপুরের করণপ্রীতের সাথে । করণ ব্রারের নাম আমরা কখনও শুনিনি।”

বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর

ছবির উৎস, ANI

ভারত সরকারের প্রতিক্রিয়া

সংবাদসংস্থা রয়টার্সের একটি প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর জানিয়েছেন, আটক তিন ভারতীয় নাগরিকের বিষয়ে কানাডার পুলিশের হাতে কী তথ্য আছে তা জানার জন্য অপেক্ষা করা হবে।

“এই ব্যক্তিদের মধ্যে কেউ অপরাধীমূলক দলে সক্রিয় ছিলেন কি না সে বিষয়ে কানাডিয়ান পুলিশ আমাদের কী তথ্য জানায় তার জন্য আমরা অপেক্ষা করব। এটা আমাদের উদ্বেগের বিষয়। ভারত থেকে কানাডায়, বিশেষত পাঞ্জাব থেকে সংগঠিত অপরাধ ঘটার অনুমতি কিন্তু তারা (কানাডা) দিয়েছে- এটাই আমাদের বক্তব্য।”

কানাডায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার সঞ্জয় ভার্মা বলেন, “এই তিন ভারতীয় সম্পর্কে কানাডার কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নিয়মিত তথ্য পাওয়ার ব্যাপারে আমরা আশাবাদী।”

“এই গ্রেফতারের ঘটনাগুলো কানাডার তদন্তের ফলাফল। এটা কানাডার অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং এ নিয়ে আমাদের কোনো বক্তব্য নেই।”

হরদীপ সিং নিজ্জরের হত্যার ঘটনায় ভারতের বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগকে কেন্দ্র করে কানাডার  সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হয়।
বিবিসি বাংলায় আরও পড়তে পারেন

হরদীপ সিং নিজ্জর

জলন্ধরের ভার সিং পুরা গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন হরদীপ সিং নিজ্জর। ভারত সরকারের তথ্য অনুযায়ী, মি. নিজ্জর খালিস্তান টাইগার ফোর্সের প্রধান ছিলেন। একইসঙ্গে তিনি খালিস্তান টাইগার ফোর্সের সদস্যদের পরিচালনা, নেটওয়ার্কিং, প্রশিক্ষণ এবং আর্থিক সহায়তা প্রদানের বিষয়ে সক্রিয় ছিলেন।

পাঞ্জাব সরকার জানিয়েছে, জলন্ধরের ভার সিং পুরায় নিজ্জরের এক একর জমি বাজেয়াপ্ত করেছে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)।

২০২০ সালে পৃথক খালিস্তান রাষ্ট্রের জন্য “শিখ রেফারেন্ডাম ২০২০” শীর্ষক অনলাইন প্রচার চালানোর জন্য মামলায় তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল।

হরদীপ সিং নিজ্জর ‘শিখস ফর জাস্টিস’-এর সঙ্গেও যুক্ত ছিল। ভারতে নিষিদ্ধ ওই সংগঠন।

অস্ট্রেলিয়ায় খালিস্তানের পক্ষে জনমত সংগ্রহের সময় মি. নিজ্জরকে দেখা গিয়েছিল।

২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে কানাডার প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো জি-২০ সম্মেলনে যোগ দিতে ভারতে এসেছিলেন। দেশে ফেরার পরপরই ১৮ই সেপ্টেম্বর কানাডার সংসদে তিনি বিবৃতি দিয়ে জানান, নিজ্জরের হত্যাকাণ্ডের পেছনে ভারত সরকারের জড়িত থাকার সম্ভাবনা নিয়ে যে অভিযোগ সেটির বিষয়ে তদন্ত চলছে।

তবে ভারতের বিরুদ্ধে হরদীপ সিং নিজ্জরের হত্যার ঘটনায় জড়িত থাকার যে অভিযোগ কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে তুলেছে তা সরাসরি অস্বীকার করেছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকার।

২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে ভারত ৪০ জন কানাডিয়ান কূটনীতিকের কূটনৈতিক দায়মুক্তি বাতিল করে। এই কারণে, কানাডিয়ান দূতাবাসের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কর্মীকে ভারত ছেড়ে কানাডায় ফিরে যেতে হয়েছিল।

ভারত জানিয়েছিল, শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কানাডা যে ছাড় দিচ্ছে তা শুধু ভারতের জন্যেই নয়, কানাডার পক্ষেও ভালো নয়।

২০২৪ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো আরও একবার নিজ্জরের হত্যা এবং ‘ভারতের সাথে জড়িত থাকার’ কথা উল্লেখ করেছিলেন। এ নিয়ে তীব্র আপত্তি জানিয়েছিল ভারত।