Source : BBC NEWS

ছবির উৎস, Sudeepto Salam
আচ্ছা, হুমায়ূন আহমেদের ঈদের নাটক কোন চ্যানেলে দেখাবে? নাম কী এবারের নাটকের? অভিনয় করেছেন কে কে? সময়টা কখন?
আশি, নব্বই দশক বা পরবর্তী সময়েও দর্শকের মধ্যে এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খেতো ঈদ আসলেই। কারণ তখন ঈদ মানেই ছিল জনপ্রিয় লেখক, নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের নাটক। শুধু ঈদ নয়, হুমায়ূন আহমেদের নাটকবিহীন দেশের কোনো উৎসব যেন অপূর্ণ থাকতো।
হুমায়ূন আহমেদের নাটকের যাত্রা শুরু হয়েছিল দেশের একমাত্র রাষ্ট্রীয় চ্যানেল বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) মাধ্যমে। নব্বই দশকের শেষ দিকে দেশের স্যাটেলাইট চ্যানেল যাত্রা শুরু করলে তখন সেখানেও প্রচার হতো হুমায়ূন আহমেদ নির্মিত নাটক।
ওই সময় ঈদ উৎসব মানেই ছিলো জনপ্রিয় এই কথা সাহিত্যিকের নির্মাণ। এমনও হয়েছে, একসঙ্গে একাধিক চ্যানেলে প্রচার হয়েছে এই লেখক ও নির্মাতার নাটক।
ঈদ ছাড়াও হুমায়ূন আহমেদের নাটক নিয়ে দর্শকদের আগ্রহ-মাতামাতির কথাও শোনা যায়। এমন কথাও প্রচলিত আছে, তার নাটক প্রচারের সময় এমনভাবে রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যেতো যেন দেশে কারফিউ চলছে।
শুধু তাই নয়, হুমায়ূন আহমেদ নির্মিত নাটকের চরিত্রের ফাঁসির প্রতিবাদে মিছিল হয়েছে এমন ঘটনার সাক্ষীও দেশের টিভি দর্শক।

ছবির উৎস, NAWAJISH ALI KHAN
যেভাবে নাটকের জগতে এলেন হুমায়ূন
গণমাধ্যমে প্রকাশিত সাক্ষাৎকার এবং নাটকের সঙ্গে যুক্ত অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৭০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ টেলিভিশনে ঈদের বিনোদননির্ভর, বা যাকে বলা চলে হাসির নাটক, সেরকম নাটক লেখা শুরু করেন চলচ্চিত্র নির্মাতা আমজাদ হোসেন।
১৯৭৫-৭৬ সালের দিকে এক ঈদের নাটকের জন্য তিনি ‘জব্বর আলী’ নামে একটি চরিত্র তৈরি করেন, যা পরবর্তীতে ঈদের সময় নানামাত্রিক গল্পে টেলিভিশনের পর্দায় উঠে আসে।
আশির দশকের শুরু পর্যন্ত জব্বর আলী প্রবল জনপ্রিয়তা পায়। কিন্তু একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তির কারণে এটির জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ে বলে জানান অনেকে।
ঠিক ওই সময়ের আর্বিভাব ঘটে হুমায়ূন আহমেদের।
তখন বাংলাদেশ টেলিভিশনে জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে চাকরি করতেন নওয়াজীশ আলী খান।
তিনি হুমায়ূন আহমেদের শুরু প্রসঙ্গে বিবিসি বাংলাকে বলেন,”আমরা তখন বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী বিভিন্ন গল্প নিয়ে নাটক নির্মাণ করতাম। সেরকম একটি গল্প ছিলো শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খাঁর লেখা ‘পাখির বিদায়’। সেই গল্পের নাটকটির শুটিং করার জন্য আমরা ধানমন্ডিতে তার (হুমায়ূন আহমেদের) বাড়ি ‘দখিন হাওয়া’ তে যাই। ইব্রাহিম খাঁ ততদিনে মারা গেছেন। তার ছেলেরা বাস করতেন সেই বাড়িতে।”
”ইব্রাহিম খাঁর ছেলে আসাদ্দুজামান আমাদের হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। বলেন, তিনি এই বাড়ির বড় জামাতা। অর্থাৎ ইব্রাহিম খাঁ ছিলেন হুমায়ূন আহমেদের দাদা শ্বশুর। ততদিনে হুমায়ূন আহমেদের দুটি উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ এবং ‘শঙ্খনীল কারাগার’ প্রকাশ পেয়েছে এবং তুমুল জনপ্রিয় হয়েছে। দুটি উপন্যাসই আমার পড়া ছিল। তাই আমি তাকে তখনই অনুরোধ করি টেলিভিশেন নাটক লেখার জন্য,” বলেন নওয়াজীশ আলী খান।
তবে শুরুতে হুমায়ূন আহমেদ রাজি হননি। তাকে রাজি করাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েও অনুরোধ করেন বলে জানান মি. খান।
ওই সময়ে হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী গুলতেকিন খানও তাকে রাজি করাতে বেশ সহযোগিতা করেছিলেন বলে জানান নওয়াজীশ আলী খান।
তিনি দাবি করেন, হুমায়ূন আহমেদের প্রথম দুটি নাটক করা সম্ভব হয়নি। তবে তার জমা দেয়া তৃতীয় নাটক ‘প্রথম প্রহর’ প্রথম প্রচারিত হয় বাংলাদেশ টেলিভিশনে। এটি ১৯৮৩-৮৪ দিকের ঘটনা বলে জানান তিনি। তবে সেটি ঈদের নাটক ছিল না।
মি. খান বলেন, “বাংলাদেশ টেলিভিশনে হুমায়ূন আহমেদের লেখা যত নাটক প্রচার হয়েছে সবচেয়ে বেশি হয়েছে আমার মাধ্যমে। সব নাটকের মহড়া এবং শুটিংয়ের সময় হাজির থাকতেন তিনি। ওই সময়ও তিনি চিত্রনাট্য ও সংলাপ পরিবর্তন করতেন। কোনো নাট্যকারকে এতটা সময় দিয়ে কাজ করতে দেখিনি।”
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন হুমায়ূন আহমেদের নাটকের বড় বৈশিষ্ট ছিল মধ্যবিত্ত পরিবারের গল্প, যেখানে মা-বাবা ভাইবোন, কাজের ছেলে বা মেয়ে থাকতেন। প্রতিটি মানুষের আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট তিনি তুলে ধরতেন। সবগুলো মিলিয়ে তিনি একটা মজার প্লট তৈরি করতেন। সহজেই সব শ্রেণির মানুষ নাটকের সঙ্গে নিজেকে মেলাতে পারতেন। এটাই সফলতার বড় কারণ।
জানা যায়, বিটিভির স্টুডিওতে হুমায়ূন আহমেদের নাটকের শুটিং হতো দুই দিন। একদিন বাইরে করতে হতো। তারপর এটি সম্পদনা করে প্রচার হতো বিটিভিতে।
সংশ্লিষ্ট অনেকেই মনে করেন ‘একদিন হঠাৎ’ নামের নাটকটি হুমায়ূন আহমেদের লেখা প্রথম ঈদের নাটক। বিটিভিতে নাটকটির প্রযোজক ছিলেন মুস্তাফিজুর রহমান। একই প্রযোজকের সঙ্গে এইসব দিনরাত্রি ধারাবাহিক তখন তুমুল জনপ্রিয় নাটক। তখনই এই দুজন মিলে তৈরি করেন ‘একদিন হঠাৎ’ নামের ঈদের বিশেষ নাটক।

ছবির উৎস, Channe I
বেসরকারি টিভিতে হুমায়ূন আহমেদ কাল
সময়টা এমন ছিল, টিভিতে ঈদের বিশেষ নাটক মানেই ছিল হুমায়ূন আহমেদের নাটক।
ঈদের বিশেষ নাটক প্রচার হওয়ার পরপরই সারাদেশে আলোচনা শুরু হয়ে যেত। কে ভালো করেছেন, কার অভিনয় দারুণ হয়েছে, কার অভিনয় আরেকটু ভালো হতে পারতো–– এই নিয়ে চলত নানা আলোচনা-সমালোচনা এবং এই আলোচনা চলতো অনেক দিন।
এমনও হয়েছে, ঈদের নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমেই অনেক নতুন অভিনয় শিল্পী রীতিমতো তারকাখ্যাতি পেয়ে যেতেন।
ঈদের নাটক প্রসঙ্গে এক লেখায় হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন, “মুস্তাফিজুর রহমান সাহেবের ফাঁদে পড়ে এক ঈদে হাসির নাটক লিখতে রাজি হলাম। সবাই খাল কেটে কুমির আনে, আমি খাল কেটে অক্টোপাস নিয়ে এলাম। এই অক্টোপাস আমাকে আট পায়ে আঁকড়ে ধরল। বাংলাদেশের মানুষদের ঈদের দিনে হাসানো আমার পবিত্র এবং মহান দায়িত্ব হয়ে গেল।”
“যেকোনো দায়িত্বের সঙ্গে টেনশন থাকে, সেই দায়িত্ব যদি মহান হয়, টেনশন ‘মহা’ হয়ে যায়। আমি দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করি রোজার শুরুতেই। স্ক্রিপ্ট লিখি, স্ক্রিপ্ট পছন্দ হয় না। আবার লিখি, আবার লিখি। বিটিভির রিহার্সেল রুমে রিহার্সেল হয়। প্রতিবারই আমি উপস্থিত থাকি। রিহার্সেল শুনে নাটক কাটাকুটি করি। প্রযোজক বিরক্ত হয়ে বলেন, এত কাটাকুটি করলে কীভাবে হবে? প্রতিদিন নতুন সংলাপ দিলে আর্টিস্ট কীভাবে মুখস্থ করবে?”
বেসরকারি চ্যানেলের সঙ্গে যুক্ত হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন এভাবে, “আগে একটা নাটক লিখতাম। টেনশন এক নাটকে সীমাবদ্ধ থাকত। এখন এক ঈদে পাঁচ-ছয়টা করে নাটক লিখতে হয়। আমি নিজে প্রচারের দিন কোনো নাটকই দেখতে পারি না। কোনটা দেখব? দর্শকেরাও নাটক দেখেন না। তাঁরা দেখেন বিজ্ঞাপন।”
তবে এসব ছাপিয়েও জনপ্রিয় হয়েছে হুমায়ূন আহমেদের নাটক।
তার ঈদ নাটকের জনপ্রিয় সিরিজ ‘তারা তিনজন’।
২০০২ সালের এক ঈদে ‘পক্ষীরাজ’ নামের নাটকটি প্রচারের পরই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন এই নাটকের তিন চরিত্র ডা. এজাজুল ইসলাম, ফারুক আহমেন ও স্বাধীন খসরু।
নাটকটিতে এই তিন অভিনেতার রসায়ন নির্মাতা ও কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের খুব পছন্দ হয়। তখনই নির্মাতা সিদ্ধান্ত নেন এই তিনজনকে নিয়ে একটি নাটক বানাবেন।
পরের ঈদের জন্য নির্মাণ করেন ‘তারা তিনজন’। ২০০০ সালের এক ঈদে নাটকটি প্রথম প্রচারিত হয়। পরে দর্শক চাহিদার কারণেই তৈরি হয় তারা তিনজন–এর সিকুয়েল।
একে একে তারা তিনজন ‘টি-মাস্টার’, ‘তারা তিনজন ঝামেলায়’, ‘তারা তিনজন হে পৃথিবী বিদায়’, ‘তারা তিনজন এবং ঝুনু খালা’সহ এই সিরিজের ১১টি নাটক প্রচারিত হয়।
হুমায়ূন আহমেদের নাটক প্রসঙ্গে বেসরকারি টিভি চ্যানেল চ্যানেল আই এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর বিবিসি বাংলাকে বলেন, “বাংলাদেশ টেলিভিশনের পরে হুমায়ূন আহমেদ প্রথম প্যাকেজের আওয়াত যে নাটক নির্মাণ করেন সেটা আমাদের চ্যানেলে প্রচার হয়। নাটকটির নাম সম্ভবত ‘নীতু তোমাকে ভালোবাসি’। তারপর থেকে যে কোনো উৎসবেই প্রচার হতো এই গুণীর নাটক।”
শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ টেলিভিশন ও চ্যানেল আইতে একসঙ্গে একই সময়ে প্রচার হতো হুমায়ূন আহমেদের নাটক। সব মিলিয়ে শতাধিক নাটক রয়েছে চ্যানেলে আইয়ের কাছে, যোগ করেন ফরিদুর রেজা সাগর।
তার মৃত্যুর পর অনেককে দিয়ে হুমায়ূন আহমেদের গল্প দিয়ে নাটক নির্মাণের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সেটি তার মতো হয়নি বলে মনে করেন তিনি।

ছবির উৎস, Abdullah al Mamun Arin
যা বলছেন অভিনয়শিল্পীরা
হুমায়ূন আহমেদের নাটকে নিয়মিত অভিনয় করতেন অভিনেতা ফারুক আহমেদ ও ডা. এজাজুল ইসলাম। ঈদের নাটকেও নিয়মিত দেখা যেতো তাদের। তাদের দাবি, হুমায়ূন আহমেদের নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমেই খ্যাতি পেয়েছেন তারা।
অভিনেতা ফারুক আহমেদ বলেন, “ঈদ আসলেই হুমায়ূন আহমেদের নাটক দু-তিনটি চ্যানেলে প্রচার হতো। বেশিরভাগ নাটকেই অভিনয় করতাম আমি। ওই সময় নাটক প্রচারের পরপরই সোরগোল পড়ে যেতো। রাস্তাঘাটে বের হতে পারতাম না।”
এদিকে ডা. এজাজুল ইসলাম বলেন, “ওই সময়ের ঈদের নাটকসহ হুমায়ূন আহমেদের সব নাটক যেমন জনপ্রিয় ছিল, এখনো সমান জনপ্রিয়। এখনো মানুষ ৩০ বছর আগের নাটক দেখেন এই জনপ্রিয়তার কারণেই। এখন যেমন হাসির নাটক, প্রেমের নাটক, উড়াধুরা নাটক হয় সেসব হুমায়ূন স্যারের এক নাটকেই পাওয়া যেতো।”
হুমায়ূন আহমেদের প্রায় শ খানেক নাটকের এই অভিনেতা দাবি করেন, “হুমায়ূন আহমেদের নাটক শুধু ওই সময় প্রাসঙ্গিক ছিল এমন না, এটি শত বছর পরও মানুষ পছন্দ করবেন। এবং সব বয়সীদের কাছে সবসময় একইরকম জনপ্রিয় হবে।”
হুমায়ুন আহমেদের নাটকে অভিনয় করা প্রসঙ্গে আরেক অভিনেতা মাহফুজ আহমেদ বলেন, “আমি ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটক থেকে শুরু করে অসংখ্য নাটকে অভিনয় করেছি। তার নাটকে অভিনয় করাটাই একটা ঈদের আনন্দ দিতো।”
“তিনি একমাত্র লেখক যিনি নাটকের দর্শক বিশেষ করে উচ্চ, মধ্য ও নিম্নবিত্তকে সুক্ষভাবে বুঝতেন এবং তুলে আনতেন। নাটকে এটা সাধারণত দেখা যায় না। এ কারণে আমার মনে হয় হুমায়ূন আহমেদের বিকল্প একমাত্র হুমায়ূন আহমেদ,” বলেন তিনি।