Home LATEST NEWS bangla সর্বশেষ সংবাদ পারভেজের মৃত্যুর দুইদিন পরেও পরিবারের কান্না থামছে না, সুষ্ঠু বিচার চায় সহপাঠীরা

পারভেজের মৃত্যুর দুইদিন পরেও পরিবারের কান্না থামছে না, সুষ্ঠু বিচার চায় সহপাঠীরা

5
0

Source : BBC NEWS

প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়

২ ঘন্টা আগে

বাংলাদেশের ঢাকায় দুই ছাত্রীকে নিয়ে হাসাহাসি করার অভিযোগ তুলে বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলাম পারভেজকে হত্যার ঘটনায় সামাজিক মাধ্যমে, এমনকি রাজনৈতিক অঙ্গনেও প্রতিক্রিয়া হয়েছে।

নিহত শিক্ষার্থীর পরিবার শোকেবিহ্বল হয়ে পড়েছে। স্থানীয় সাংবাদিকরা বলেছেন, নিহত শিক্ষার্থীর বাবা-মা এমনকি কারো সাথে ঠিকমতো কথাও বলতে পারছেন না। বাড়িটিতে দুইদিন ধরে কান্না আর আহাজারি চলছে।

সামান্য একটি অভিযোগের ভিত্তিতে একজন শিক্ষার্থীকে এভাবে হত্যার ঘটনা সারা দেশজুড়ে নাড়া দিয়েছে। যদিও পুলিশ তিন জনকে আটক করেছে পুলিশ। সোমবার আদালত তাদের সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে।

তবে নিহত শিক্ষার্থীর সহপাঠীরা প্রতিবাদের পাশাপাশি দাবি করেছে, এই ঘটনাকে নিয়ে রাজনীতিকরণ নয়, বরং সুষ্ঠু বিচার চায়।

পারভেজ হত্যার প্রতিবাদে সোমবার সারাদেশে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছে ছাত্রদল। প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও বিক্ষোভ করেছে।

নিহত পারভেজের পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে তাদের বিরুদ্ধেও মামলার পরিকল্পনা করছেন তাদের।

বনানীতে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের কাছে একটি দোকানে ‘ছাত্রীকে উত্যক্ত করার অভিযোগ’ নিয়ে বিবাদের জেরে শনিবার টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলাম পারভেজকে ছুরিকাঘাত করে হত্যার ঘটনা ঘটে।

এর আগে দুই ছাত্রীর অভিযোগের পর পারভেজকে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রক্টর অফিসে ডাকা হলে তিনি অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছিলেন যে তারা বন্ধুরা নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করছিলেন। তারপরেও দুই ছাত্রীর কাছে ক্ষমাও চেয়েছিলেন তিনি।

কিন্তু প্রক্টর অফিস থেকে বেরিয়ে আসার পরেই তিনি হামলার শিকার হন এবং তুচ্ছ এই ঘটনাটি শেষ পর্যন্ত হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত গড়ায়।

ঘটনার পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বনানী এলাকার একজন নেতাকে মামলায় আসামি করা হয়েছে এবং পারভেজের ছাত্র সংগঠন ছাত্রদল সংবাদ সম্মেলনে করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের জড়িত থাকার অভিযোগ করেছে।

তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে একে ছাত্রদলের মিথ্যাচার আখ্যায়িত করেছে।

মানবাধিকার সংগঠক, সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ এবং পুলিশের একজন সাবেক প্রধান বলছেন, পুরো ঘটনায় সামাজিক ও মানসিক অস্থিরতার পাশাপাশি ক্ষমতা প্রদর্শন, নিজের হাতে শাস্তি দেয়ার প্রবণতা এবং বিচারহীনতার প্রতিফলন ঘটেছে।

বিবিসি বাংলায় আরও পড়ুন:
পারভেজ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে তিনজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ (ফাইল ফটো)

ছবির উৎস, Getty Images

ছোট ঘটনাও কেন এমন রূপ নেয়

বাংলাদেশে দলবদ্ধ হয়ে হামলার ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে বারবার আলোচনায় এসেছে। কখনো ঘোষণা দিয়ে কিংবা কখনো হুট করে কোন ঘটনার জের ধরে, এসব ঘটনা ঘটলেও তাতে তাৎক্ষণিক আইনি পদক্ষেপ খুব একটা দেখা যায় না।

বিশেষত একের পর এক ঘটনায় শিরোনাম হয়েছে ‘মব জাস্টিস’ অর্থাৎ দলবদ্ধ হয়ে হামলা বা সন্ত্রাসী কার্যক্রমের ঘটনা। কিন্তু তার বেশিরভাগেরই শিকার হয়েছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে জড়িতরা বা তাদের বাড়িঘর।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে টাকা পয়সা আদায় অর্থাৎ চাঁদাবাজির জন্যও ‘ফ্যাসিস্ট সহযোগী’ আখ্যা দিয়ে দলবদ্ধ হামলার ঘটনা ঘটছে।

কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের সামান্য ভুল আচরণ বা ত্রুটির অভিযোগে হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

মানবাধিকার সংগঠক নূর খান লিটন বলছেন, সমাজে অস্থিরতা চলছে এবং এর জের ধরে নানা ধরনের নৈরাজ্য হচ্ছে। আর এ ধরনের পরিস্থিতি থাকলে অনেকেই সুযোগ নিতে চায়।

“প্রতিশোধ স্পৃহা কিংবা বাণিজ্যের জন্য মব জাস্টিস বা পিটিয়ে পুলিশে দেয়ার মতো ঘটনা ঘটছে। প্রাইমএশিয়ার তুচ্ছ ঘটনাটি সংঘবদ্ধ চক্রের কাজ। তারা মনে করেছে যাই করবে তা প্রশ্ন বা বিচারের ঊর্ধ্বে থাকবে”।

আবার কেউ কেউ মনে করেন, এখনকার সামাজিক পরিস্থিতি ও আচরণগত অস্থিরতার প্রতিফলন হলো সামান্য একটি ঘটনার পর প্রাণ দেয়ার মতো ঘটনা।

জাহিদুল ইসলাম পারভেজ

ছবির উৎস, ARJU AHMAD/FACEBOOK

সাধারণত যেকোনো প্রতিষ্ঠান বা জায়গাতেই মানুষের মধ্যে ছোটখাটো ত্রুটি বিচ্যুতি বা আচরণগত ভুল হয়ে থাকে। এগুলো কখনো আলোচনা আবার কখনো প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে মিটমাটও হয়। বড় ঘটনা হলে সেগুলোর আইনি প্রতিকারেরও সুযোগ থাকে একটি সুস্থ সমাজে।

“কিন্তু আমাদের দেশে সবাই ক্ষমতা, প্রভাব, আধিপত্য কিংবা রাজনৈতিক পরিচয় প্রদর্শন করে নিজেকে জাহির করতে চায়। আর এমন ধরনের মানুষ যখন সমাজে বেশি হয়ে যায়, তখন ছোট ঘটনাও বড় অপরাধে পরিণত হতে পারে। তারই একটি উদাহরণ হলো প্রাইম এশিয়ার ঘটনা,” বলছিলেন সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ডঃ তৌহিদুল হক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষকের মতে- মূলত দেখে নেয়ার মানসিকতা আর বিচারহীনতার কারণে আইন হাতে তুলে নেয়ার প্রবণতার কারণে সমাজে তুচ্ছ ঘটনা মুহুর্তে রক্তক্ষয়ী কিংবা প্রাণহানির মতো ঘটনার জন্ম দিচ্ছে।

যদিও বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনা একেবারেই নতুন নয়। পাড়া মহল্লা কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনেকের সামান্য ভুল ত্রুটির জের ধরে নির্মম পিটুনি, এমনকি মেরে ফেলার ঘটনা আগেও ঘটেছে।

কিন্তু এসব ঘটনার পর বিচার হওয়ার উদাহরণ খুব বেশি নেই। অনেক ক্ষেত্রে পুলিশের দেরীতে সক্রিয় হওয়া, আবার অনেক ক্ষেত্রে মামলা হলেও তাতে প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী না পাওয়াসহ নানা কারণে শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত আইনি প্রতিকার পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

অনেকে মনে করেন, এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে আগে সমাজ যে ভূমিকা রাখতো এখন সেটি হচ্ছে না এবং এর ফলে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ কমেছে।

আবার সাম্প্রতিক মাসগুলোতে দেশের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী পুরো সক্ষমতা প্রদর্শন করতে পারছে না বা কোনো কোনো গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দলবদ্ধ হামলার পর পুলিশ ব্যবস্থাও নিতে পারছে না বলে অভিযোগ আছে।

পুলিশের সাবেক আইজিপি নূরুল হুদা বলছেন, যারা এসব অপরাধ করছে তারা কারও কারও প্রশ্রয় পাচ্ছে।

“দুঃখজনক হলেও মব জাস্টিসের একটা ধারণা এসে গেছে। এগুলো বন্ধ করতে অ্যাকশন দরকার। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে তাদের কাজ করতে হবে। বিচারের আওতায় আনতে হবে। অপরাধী জেলে গেলে সেটা থেকেও বার্তা আসে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন ।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন অপরাধের দ্রুত ও কার্যকর বিচার জরুরি।

ছবির উৎস, Getty Images

পারভেজ কে এবং যা ঘটেছিলো

জাহিদুল ইসলাম পারভেজ হত্যার ঘটনায় থানায় মামলা করেছেন তার মামাতো ভাই হুমায়ুন কবির। তার এ মামলায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই নেতাসহ আটজনের নাম উল্লেখ করা হয়। এছাড়া নাম না দিয়ে আরও ২৫-৩০ জনকে আসামি করা হয়।

পুলিশ যাদের আটক করেছে তারা মামলার প্রধান আসামির বন্ধু। তারা কেউই প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নয়।

রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে পারভেজকে নিজেদের কর্মী দাবি করে এ হত্যাকাণ্ডে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বনানীর কয়েকজন নেতার জড়িত থাকার অভিযোগ করে বিএনপির সহযোগী সংগঠন ছাত্রদল।

যদিও অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তারা ছাত্রদলের বিরুদ্ধে মিথ্যাচারের অভিযোগ করেছেন।

তবে নিহত পারভেজের মামা সিরাজ মিয়া বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, তার ভাগ্নে ছাত্রদলের রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলো এবং খুবই সজ্জন প্রকৃতির মানুষ ছিলো।

পারভেজের সহপাঠী মুহাম্মদ আবু হানিফ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ”পারভেজ ভাই একজন সম্ভাবনাময় মেধাবী ছাত্র ছিলেন। এত তুচ্ছ একটা ঘটনায় কেন তার মৃত্যু হবে? কেন সেই বিচার পেতে তার রাজনৈতিক পরিচয় পেতে হবে? আমাদের দাবি, রাজনীতি নয়, সুষ্ঠু বিচার করতে হবে।”

পারভেজের বাবা কুয়েতে থাকেন এবং ঘটনার খবর পেয়ে তিনি ইতোমধ্যেই দেশে এসে পৌঁছেছেন। পারভেজ ও তার বোন ঢাকায় থেকে পড়াশোনা করলও তার পরিবারের অন্যরা ময়মনসিংহের ভালুকায় নিজেদের বাড়িতে বসবাস করে।

রোববার বিকালে সেখানেই পারভেজকে দাফন করা হয়েছে।

স্থানীয় সাংবাদিকরা জানিয়েছেন, পরিবারটি শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েছে।

মামলার বিবরণ ও পারভেজের সহপাঠীদের কাছ থেকে ঘটনার যে বর্ণনা পাওয়া গেছে তা হলো পারভেজ বন্ধুদের সাথে একটি দোকানে আড্ডা দিচ্ছিলো। তাদের কাছেই ইংরেজি ও ইন্টারন্যাশনাল হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্টের কয়েকজন শিক্ষার্থীদের সাথে অন্য একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন ছাত্রীও ছিলো।

তারা পারভেজের বিরুদ্ধে উত্যক্ত করার অভিযোগ করেন। পরে প্রাইমএশিয়ার প্রক্টরের কাছেও যান তারা।

প্রক্টর এ ঘটনায় পারভেজকে ডেকে নিলে পারভেজ অভিযোগ অস্বীকার করে জানান যে, তারা বন্ধুরা নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করছিলেন। এক পর্যায়ে প্রক্টর তাকে দুই ছাত্রীর কাছে ক্ষমা চাওয়ার পরামর্শ দিলে তিনি তাদের কাছে ক্ষমা চান।

কিন্তু সেখানেই ইংরেজি বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থী পারভেজকে হুমকি দিচ্ছিলেন। এরপর প্রক্টর অফিস থেকে বের হওয়ার পর একদল বহিরাগত এসে তাকে ছুরিকাঘাত করে।

পরে এক ভিডিওতে দেখা যায় রক্তাক্ত পারভেজ পেটে হাত দিয়ে একটি চেয়ারে বসে আছেন আর কাছে থাকা কয়েকজন তারা সাড়া পাওয়ার চেষ্টা করছেন। রক্তাক্ত অবস্থাতেই তার সহপাঠীরা তাকে হাসপাতালে নিলেও চিকিৎসকরা জানান আগেই তার মৃত্যু হয়েছে।