Home LATEST NEWS bangla সর্বশেষ সংবাদ সিমলায় কিশোরী বেনজির, মীনাকুমারীর ‘পাকিজা’ আর একটি ‘নড়বড়ে’ চুক্তি

সিমলায় কিশোরী বেনজির, মীনাকুমারীর ‘পাকিজা’ আর একটি ‘নড়বড়ে’ চুক্তি

2
0

Source : BBC NEWS

সিমলাতে ইন্দিরা গান্ধী ও জুলফিকার আলি ভুট্টোর করমর্দন, ছবিতে বাবার পাশে কিশোরী বেনজির ভুট্টো। ২৮শে জুন, ১৯৭২

ছবির উৎস, Getty Images

একাত্তরের যুদ্ধ শেষ হওয়ার মাত্র কয়েক মাসের মাথায় ভারতের সঙ্গে ‘শান্তি আলোচনায়’ বসতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলি ভুট্টো যখন হিমাচলের শৈলশহর সিমলাতে এলেন, তখন তার স্ত্রী বেগম নুসরত ভুট্টো বেশ অসুস্থ – তাই তিনি সঙ্গে করে এনেছিলেন নিজের বড় মেয়ে, কিশোরী বেনজিরকে। বেনজির ভুট্টো তখন সবে উনিশে পা দিয়েছেন।

এটা ‘৭২ সালে জুনের শেষ সপ্তাহের কথা – আর তার কিছুদিন আগেই ভারতে মুক্তি পেয়েছে কামাল আমরোহির ব্লকবাস্টার ছবি ‘পাকিজা’।

ছবি থিয়েটারে আসার পর দু’মাস না পেরোতেই মারা গেলেন ছবির নায়িকা মীনাকুমারী, তখন তার বয়স চল্লিশও হয়নি। বলিউডের ‘ট্র্যাজেডি কুইন’ ভক্তদের চোখের জলে ভাসিয়ে বিদায় নিলেন, আর পাকিজা-র বক্স অফিস চড়চড় করে বাড়তে থাকল।

মীনাকুমারী ওরফে মাহজাবিন বানো পাকিস্তানেও অসম্ভব জনপ্রিয় ছিলেন, আর ষাটের দশকে বলিউডের ছবি পাকিস্তানে নিয়মিত মুক্তিও পেত। কিন্তু যুদ্ধের আবহে পাকিস্তানের দর্শকরা ‘পাকিজা’ যথারীতি দেখতে পাননি।

কাজেই সিমলার ‘বার্নস কোর্টে’ (এখন যার নাম রাজভবন) আসা কিশোরী অতিথিকে যখন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী জিজ্ঞেস করলেন তোমার জন্য আমরা কী করতে পারি, বেনজির না কি জবাব দিয়েছিলেন “একটা সিনেমা হলে গিয়ে পাকিজা দেখতে পেলে ভালো লাগবে!”

যে-ই কথা, সে-ই কাজ। সিমলার ডেপুটি কমিশনারকে বলে সঙ্গে সঙ্গে শহরের ব্রিটিশ আমলের খানদানি সিনেমা হল ‘রিটজ’-এ পাকিজার বিশেষ স্ক্রিনিং-এর ব্যবস্থা করা হল। সিমলায় বেনজিরের সার্বক্ষণিক দেখাশুনোর দায়িত্বে ছিলেন ভারতীয় ফরেন সার্ভিসের কর্মকর্তা বীণা দত্ত, তিনিও যথারীতি সঙ্গে গেলেন।

বলিউডের কাল্ট মুভি ‘পাকিজা’র পোস্টার

ছবির উৎস, Getty Images

সে দিন সিনেমা হলে মাত্র তিনজন দর্শকই ছিলেন। তৃতীয়জন ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের আমলা মহারাজ কৃষেণ কাও (এম কে কাও নামেই বেশি পরিচিত), যিনি ২০১২ সালে নিজের স্মৃতিকথা ‘অ্যান আউটসাইডার এভরিহোয়ার’ বইতে এই গোটা ঘটনার বিবরণ লিখে গেছেন।

বস্তুত কিশোরী বেনজিরের উপস্থিতি সিমলার সেই রুক্ষশুষ্ক বৈঠকের পরিবেশে যে একটা আলাদা মাত্রা যোগ করেছিল, সেটা ওখানে উপস্থিত অনেকেই পরে জানিয়েছেন বা লিখে গেছেন।

প্রেসিডেন্ট ভুট্টোর সঙ্গে প্রবল কূটনৈতিক দরকষাকষি বা বেশ কয়েক দফা ব্যর্থ বৈঠকের ফাঁকেও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কিন্তু ওই কয়েকদিনে বাচ্চা মেয়েটির খোঁজখবর নিতে ভুলতেন না।

‘শপিং-এ পার্স বের করতে দেবে না’

সিমলা চুক্তির খসড়া বয়ানটি যিনি টাইপরাইটারে টাইপ করেছিলেন, হিমাচলের তখনকার রাজ্যপাল এস চক্রবর্তীর ব্যক্তিগত সচিব সেই এ এন বারোওয়ালিয়া সম্প্রতি এ প্রসঙ্গে একটি মজার ঘটনা জানিয়েছেন।

এখন ৮৪ বছর বয়সী মি বারোওয়ালিয়া বলছেন, “প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ছিল বেনজির ভুট্টোর মেজাজ খুশ রাখতে হবে – কাজেই ওকে সিমলার ম্যাল রোডে শপিং করাতে নিয়ে যাওয়ার ভার পড়েছিল রাজভবনের কর্মীদের ওপর।”

স্টাফ মেম্বাররা যখন কিশোরী মেয়েটিকে নিয়ে কেনাকাটায় বেরোচ্ছেন, প্রধানমন্ত্রী নিজে আবার ডেকে তাদের বলে দেন, “খেয়াল রাখবে শপিং-এর সময় ওকে যেন নিজের পার্স কখনওই বের করতে না হয়!”

শৈলশহর সিমলার বিখ্যাত ম্যাল রোড, এখন যেমন চেহারায়

ছবির উৎস, Getty Images

ইন্দিরা নিজে তার মা কমলা নেহরুকে হারিয়েছিলেন মাত্র ১৯ বছর বয়সে – এবং পরে পিতা জওহরলাল নেহরুর প্রধানমন্ত্রিত্বের দীর্ঘ সময়টায় তিনি বাবার হয়ে বহু বিদেশি অতিথিকে আপ্যায়ন করেছেন, কাজেই সিমলায় কিশোরী বেনজিরের মধ্যে তিনি নিজের ছায়া দেখতে পেলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।

যে কোনও কারণেই হোক, বেনজির ভুট্টো ওই কয়েকটা দিন ইন্দিরার অগাধ স্নেহ পেয়েছেন।

আর মোটামুটি সবাই এটা মানেন, সিমলা বৈঠক প্রায় ভেস্তে যেতে বসলেও চুক্তি শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয়েছিল শেষ দিনে ইন্দিরা আর ভুট্টোর প্রায় ভোররাত অবধি গড়ানো একান্ত আলোচনাতেই।

পরে সেই সিমলা চুক্তির ব্যাখ্যা নিয়ে অনেক বিতর্ক ও বিরোধ হয়েছে, দু’পক্ষই পরস্পরের বিরুদ্ধে চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করার অভিযোগও এনেছে।

তবে সেই ‘৭২ সালে এটাকে দুদেশের জন্য বড় কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবেই বিবেচিত হয়েছিল – যে যারা মাত্র কয়েকমাস আগেও এত বড় যুদ্ধে লিপ্ত ছিল, সেই দুটো দেশ নিজেদের মধ্যে সব সমস্যা শান্তিপূর্ণ পথে ও আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে রাজি হয়েছে!

পরে প্রথমবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে বেনজির ভুট্টো নিজেও সিমলা চুক্তির প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

সম্পর্কিত খবর :
নিহত হওয়ার ঠিক দু’মাস আগে পাকিস্তানে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বেনজির ভুট্টো। অক্টোবর, ২০০৭

ছবির উৎস, Getty Images

ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব জে এন দীক্ষিত তার বইতে লিখেছেন, বেনজির তাঁকে বলেছিলেন সিমলায় যখন যান তিনি তখনও ছাত্রী, মূল আলোচনাতেও তার কোনও ভূমিকা ছিল না – কাজেই তার বাবা বৈঠকে যদি কোনও মৌখিক আশ্বাস দিয়েও আসেন সেটা তার জানার কথা নয়। ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তার শেষ একান্ত আলাপ নিয়েও বাবা কখনও তার কাছে মুখ খোলেননি বলে জানান বেনজির।

দ্বিতীয়ত, সিমলা চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর দুই দশকেরও বেশি সময় তখন কেটে গেছে – কাজেই কাশ্মীর তথা উপমহাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে চুক্তির অনেকগুলো ধারা নিয়ে নতুন করে ভাবার দরকার কি না, সে কথাও বলেছিলেন তিনি।

গত মাসে পহেলগাম হামলার পর ভারত যখন তাদের দিক থেকে সিন্ধু চুক্তি স্থগিত রাখার কথা ঘোষণা করে, পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে পাকিস্তানও কিন্তু সিমলা চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার কথা জানায়। যদিও অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করেন, সিমলা চুক্তি আসলে বহুদিনই ‘মৃতপ্রায়’।

যেভাবে চুক্তির পথ প্রশস্ত হয়েছিল

সিমলা চুক্তি নিয়ে বহু বিবাদ-বিসম্বাদ থাকলেও প্রায় ৫৩ বছর আগে চুক্তিটি যে দারুণ নাটকীয় পরিস্থিতিতে স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তাতে কিন্তু কোনও ভুল নেই।

একাত্তরের ডিসেম্বরে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, পাকিস্তানি সেনার আত্মসমর্পণ এবং বিশ্বের মানচিত্র থেকে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ মুছে গিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম – এতসব ঘটনার ঘনঘটার মাত্র মাসছয়েকের মধ্যে দুই দেশের নেতারা এক টেবিলে বসবেন, এটাই অনেকে ভাবতে পারেননি।

পর্দার আড়ালে এই বৈঠকে একটা বড় ভূমিকা পালন করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন, যাদের সঙ্গে মাত্র কয়েকমাস আগেই ভারত একটি মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করে।

তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট ছিলেন সের্গেই ব্রেজনেভ

ছবির উৎস, Getty Images

সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট সের্গেই ব্রেজনেভের নির্দেশে মস্কোতে নিযুক্ত ভারতীয় ও পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পাঠিয়ে দুই দেশের ওপরই চাপ দেওয়া হতে থাকে যাতে ইন্দিরা গান্ধী ও জুলফিকার আলি ভুট্টো আলোচনায় বসেন।

ভারতের দিক থেকে বৈঠকে বসার একটা বড় তাগিদ ছিল প্রায় ৯৩ হাজার পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীকে নিয়ে কী করা হবে – যাদের বেশির ভাগই ছিলেন সেনা ও আধাসেনা বাহিনীর সদস্য। এটা পাকিস্তানের দিক থেকেও ছিল বৈঠকে বসার অন্যতম কারণ।

তা ছাড়া বিতর্কিত কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে আগামী দিনে দুই দেশ কীভাবে এগোবে, তারও একটা ফয়সালা হওয়া দরকার ছিল।

অবশেষে বৈঠকের দিনক্ষণ চূড়ান্ত হওয়ার পর ইন্দিরা গান্ধী নিজে সিমলার বার্নস কোর্টে ঘরের পর্দা, সোফার কভার সব নিজে পছন্দ করে সাজসজ্জার ব্যবস্থা করেন – যেখানে পাকিস্তানের প্রতিনিধিদলকে আতিথেয়তা দেওয়া হবে।

তবে মূল বৈঠক শুরু হওয়ার পর দেখা গেল আলোচনায় অগ্রগতি খুবই কঠিন হচ্ছে। মূলত কাশ্মীর প্রশ্নের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি নিয়েই আলোচনা বারবার থমকে যাচ্ছিল বলে ইতিহাসবিদরা অনেকেই জানিয়েছেন।

ভারতীয় পর্যবেক্ষকরা অনেকেই লিখেছেন, ইন্দিরা গান্ধী ও তার উপদেষ্টারা যখন কাশ্মীরের ‘যুদ্ধবিরতি রেখা’কে স্থায়ী সীমান্তে রূপান্তরিত করার জন্য জেদ ধরে ছিলেন, ভুট্টো তখন না কি বলেছিলেন তার দেশ এটার জন্য প্রস্তুত নয় – তাদের রাজি করাতে সময় লাগবে।

“আমার ওপর ভরসা রাখুন, আমি দেশে ফিরে দু’সপ্তাহের ভেতর এটার জন্য জমি প্রস্তুত করে ফেলব”, ভুট্টোকে উদ্ধৃত করে লিখেছেন ইন্দিরা গান্ধীর সে সময়কার সচিব ও অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পি এন ধর। সে প্রতিশ্রুতি অবশ্য তিনি কখনওই রাখেননি।

সিমলা কনফারেন্সের সময় প্রধানমন্ত্রী গান্ধী ও প্রেসিডেন্ট ভুট্টো

ছবির উৎস, Getty Images

আর জুলফিকার আলি ভুট্টো অনেক পরে তার জেলে বসে লেখা ডায়েরিতে (‘নোটস ফ্রম ডেথ সেল’) দাবি করেছেন তার কূটনৈতিক চালেই সিমলা বৈঠকে ভারত কাশ্মীরকে একটি ‘বিতর্কিত বিষয়’ বলে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল।

ভুট্টোর বক্তব্য অনুযায়ী, আলোচনার এজেন্ডায় কাশ্মীরকে ঢোকানোর ব্যাপারে তিনি বদ্ধপরিকর ছিলেন। কিন্তু এ ব্যাপারে ইন্দিরা গান্ধীর ওপর তার উপদেষ্টাদের ‘চাপ’ ছিল – এবং মাঝে মাঝে বৈঠকে ইন্দিরা নিজেও না কি অন্যমনস্ক ও বিতৃষ্ণ হয়ে পড়তেন।

“পরে একদিন যখন আমি ঘরে একা, আমার ঘরে টোকা দিয়ে ঢুকলেন মিসেস গান্ধীর একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী ডি পি ধর। যে বিষয়গুলোতে জট, তা খোলার বিকল্প রাস্তা কী হতে পারে সেটা নিয়ে আমাদের মধ্যে আধঘন্টা একান্তে কথা হল”, লিখেছেন ভুট্টো।

এর পরদিন কিন্তু ইন্দিরা গান্ধীকে অনেক ‘রিল্যাক্সড’ দেখাচ্ছিল – এবং শেষ পর্যন্ত এই ‘আচরণের অ্যাডজাস্টমেন্ট’টাই চুক্তির সম্পাদন সম্ভব করেছিল বলে দাবি করেছেন জুলফিকার আলি ভুট্টো।

চুক্তিতে যে সব বিষয়ে মতৈক্য হয়েছিল

ঘটনা হল ‘সিমলা কনফারেন্সে’র নির্ধারিত শেষ দিন, ২রা জুলাই বিকেলেও চুক্তি সই হওয়ার কোনও সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছিল না।

ভুট্টো-সহ পাকিস্তানি প্রতিনিধিদলের দেশে ফেরার ব্যবস্থা করতে তাই কনফারেন্স শেষ হওয়ার কয়েক ঘন্টা আগেই চন্ডীগড় পৌঁছে গিয়েছিলেন ভারতীয় ডিপ্লোম্যাট ত্রিলোকী নাথ কাউল।

গভীর রাতে তাকে অবাক করে খবর পৌঁছয় যাত্রা পেছোবে, কারণ ইন্দিরা গান্ধী ও জুলফিকার আলি ভুট্টো আলোচনার জট খুলতে নিজেদের মধ্যে একান্তে কথাবার্তা বলছেন।

১৯৭২-র ৩রা জুলাই ভোররাতে চুক্তিপত্রে সই করছেন পাকিস্তান ও ভারতের নেতারা

ছবির উৎস, Getty Images

অবশেষে ভোররাতের দিকে চুক্তির বয়ান নিয়ে তারা ঐকমত্যে পৌঁছন, আর ড্রাফট ও টাইপিং সেরে সইসাবুদ হতে হতে প্রায় সকালের আলো ফুটছে!

সে কারণে দলিল-দস্তাবেজে সিমলা চুক্তির তারিখ ২রা জুলাই, ১৯৭২ হিসেবে উল্লিখিত থাকলেও আসলে চুক্তিটা স্বাক্ষরিত হয়েছিল ৩রা জুলাই।

এই ঐতিহাসিক চুক্তিতে ভারত ও পাকিস্তান যে মূল বিষয়গুলোতে সম্মত হয়েছিল সেগুলো ছিল এরকম :

  • শান্তিপূর্ণ ও দ্বিপাক্ষিক সমাধান : উভয় দেশই তাদের মধ্যে যাবতীয় বিরোধ ও বিতর্ক নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে মীমাংসা করবে, কোনও তৃতীয় পক্ষকে এর মধ্যে জড়ানো হবে না।
  • নিয়ন্ত্রণরেখা (লাইন অব কন্ট্রোল) : জম্মু ও কাশ্মীরের ‘সিজফায়ার লাইন’ বা ‘যুদ্ধবিরতি রেখা’-কে এখন থেকে নিয়ন্ত্রণরেখা বা এলওসি বলে অভিহিত করা হবে এবং কোনও পক্ষই একতরফাভাবে এই রেখা পাল্টানোর চেষ্টা করবে না। (যার অর্থ হল, স্থায়ী সীমান্ত না হলেও এই এলওসি ‘ডি ফ্যাক্টো’ বর্ডার হিসেবেই থাকবে)
  • যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি : ভারত তাদের হেফাজতে থাকা সব পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীকে নিজ দেশে ফেরত পাঠাবে।
  • বাংলাদেশকে স্বীকৃতি : পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকবে এবং বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি দেবে।

এই চুক্তি যে টেবিলে বসে দুই নেতা স্বাক্ষর করেছিলেন, সেটি সিমলার রাজভবনে আজও সযত্নে রক্ষিত আছে। টেবিলের সোনালি ট্রিমগুলো নিয়মিত পালিশও করা হয়।

হিমাচল প্রদেশের রাজভবনে এই টেবিলেই স্বাক্ষরিত হয়েছিল সিমলা চুক্তি

ছবির উৎস, PTI

বেশ কিছুদিন হল শনি ও রোববার সাধারণ দর্শনার্থীরা টিকিট কেটে গিয়ে সেই হলঘর আর টেবিলটি দেখেও আসতে পারেন। ভারতীয়দের জন্য টিকিটের মূল্য মাত্র ৩০ রুপি, শিশুদের জন্য ফ্রি।

কিছুদিন আগেও ওই টেবিলে ভারত ও পাকিস্তানের পতাকা পাশাপাশি শোভা পেত – তবে এখন আর পাকিস্তানি পতাকাটি (যেটি জুলফিকার আলি ভুট্টো নিজে সঙ্গে করে এনেছিলেন) দেখা যায় না, ওটি সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

সিমলা চুক্তির দুর্বলতাগুলো যেখানে

ভোররাতে চুক্তিতে সইসাবুদ সেরে সে দিন দুপুরে (৩রা জুলাই) পাকিস্তানে ফিরেই জুলফিকার আলি ভুট্টো দেশবাসীকে জানান, কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তান যে এক ফোঁটাও আপস করবে না সেটা এই চুক্তির মধ্যে দিয়ে পরিষ্কার।

কাশ্মীরে পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে থাকা ভূখন্ডের এক বর্গইঞ্চিও যে হাতছাড়া হয়নি, এবং কাশ্মীরকে দুদেশের মধ্যে একটি ‘বিতর্কিত বিষয়’ হিসেবে মেনে নেওয়া হয়েছে – এটাই ছিল ভুট্টোর দাবির স্বপক্ষে প্রচ্ছন্ন যুক্তি।

তিনি আরও বলেন, “আত্মনিয়ন্ত্রণ বা সেলফ ডিটারমিনেশনের অধিকার কাশ্মীরিদের একটি মৌালিক অধিকার, সেটা যে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না তা আরও একবার প্রমাণিত হল।”

এদিকে ভারতে বিরোধী দলগুলো সিমলা চুক্তির তীব্র বিরোধিতা করে এটিকে ‘কালা চুক্তি’ বলে বর্ণনা করতে থাকে। ভারতের অনেক বুদ্ধিজীবীরাও এই চুক্তির বিরুদ্ধে সরব হন।

জাতিসংঘে ভারতীয প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বক্তৃতা শুনছেন জুলফিকার আলি ভুট্টো। তখন তিনি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী

ছবির উৎস, Getty Images

আজকের বিজেপি তখন পরিচিত ছিল জনসঙ্ঘ নামে, সেই দলের শীর্ষ নেতা অটলবিহারী বাজপেয়ী অভিযোগ করেন এই চুক্তিতে দেশের স্বার্থকে বিকিয়ে দেওয়া হয়েছে।

তার বক্তব্য ছিল, যে পাকিস্তান অতীতে বারবার নিজে থেকে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়েছে তারা শান্তিপূর্ণ পথে বিরোধ মীমাংসার চেষ্টা করবে এটা ভাবাটাই বোকামি।

তা ছাড়া কাশ্মীরের ৩০০০ বর্গমাইল এলাকা যেখানে পাকিস্তানের দখলে, সেটা ফেরত না নিয়ে ভারত কীভাবে তাদের দখলে থাকা পশ্চিম পাকিস্তানের ৫০০০ বর্গমাইল ফেরত দিয়ে দিচ্ছে, সে প্রশ্নও তোলেন মি বাজপেয়ী।

বস্তুত ভারতে ইতিহাসবিদ পি অজিতকুমারের মতো অনেক বিশ্লেষকই মনে করেন, একাত্তরের যুদ্ধে ইন্দিরা গান্ধী ‘সামরিক জয়’ পেলেও তার কয়েক মাসের মধ্যেই কিন্তু সিমলাতে তাকে একটা অপমানজনক ‘কূটনৈতিক পরাজয়’ হজম করতে হয়েছিল।

হাজার হাজার যুদ্ধবন্দী, দখলে থাকা বেশ কয়েক হাজার বর্গমাইল পাকিস্তানি ভূখন্ড – দরকষাকষির এরকম সাঙ্ঘাতিক সব অস্ত্র থাকা সত্ত্বেও কাশ্মীর বা অন্যান্য ইস্যুতে তিনি তার ফায়দা তুলতে পারেননি বলেই ভারতে অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন।

অন্য দিকে পাকিস্তানে অনেক পর্যবেক্ষকের বক্তব্য – যুদ্ধে পাকিস্তানের শোচনীয় পরাজয়ের মাত্র কয়েকমাসের মধ্যে যেভাবে ভারত সিমলাতে চুক্তির শর্তগুলো তাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল সেটাকে ন্যায়সঙ্গত বলা চলে না, বরং এটা ছিল এক ধরনের ‘ভিক্টর’স জাস্টিস’ বা বিজয়ীপক্ষের বিচার।

ভারতে বিরোধী দল জনসঙ্ঘর নেতা অটলবিহারী বাজপেয়ী সিমলা চুক্তির তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন

ছবির উৎস, Getty Images

কার্যক্ষেত্রেও দেখা গেছে গত ৫৩ বছরে পাকিস্তানে সামরিক বা গণতান্ত্রিক – যে ধরনের সরকারই থাকুক, তারা এই চুক্তির শর্তগুলো মানার ব্যাপারে কখনওই তেমন গরজ দেখায়নি।

ইসলামাবাদের শিফা তামির-ই-মিলাত ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও আন্তর্জাতিক আইনের বিশেষজ্ঞ মুহাম্মদ মুশতাক আহমেদ মনে করেন, “সিমলা চুক্তি নিয়ে প্রধান সমস্যা হল ভারত মনে করে এটি কাশ্মীর নিয়ে জাতিসংঘের প্রস্তাবকে বাতিল বা সুপারসিড করে দিচ্ছে।”

বস্তুত ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত প্রস্তাবে কাশ্মীরে একটি গণভোট বা ‘প্লেবিসাইট’ আয়োজনের দাবিকে সমর্থন জানানো হয়েছিল, ভারত যা কখনওই মানতে চায়নি।

সিমলা চুক্তি কাশ্মীরকে আবার দ্বিপাক্ষিক আলোচনার কাঠামোতে ফেরত এনেছে বলে ভারত যুক্তি দিয়েছে – স্বাভাবিক কারণেই যেটা পাকিস্তানের কাছে কখনওই গ্রহণযোগ্য ছিল না।

পাকিস্তান সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও বিশ্লেষক আহমেদ বিলাল সুফি আবার বলছিলেন, “যুদ্ধের ঠিক পর পর সিমলা একটা ‘ইন্টেরিম’ বা অন্তর্বতী অ্যারেঞ্জমেন্ট ছিল, এটা আমাদের মনে রাখতে হবে।”

তবে তা সত্ত্বেও গত তিপান্ন বছরের একটা বড় সময়, বিশেষ করে তুলনামূলক শান্তির পর্বগুলোতে, এই চুক্তি যে দুই দেশের মধ্যে শান্তিরক্ষায় একটা বড় ভূমিকা রেখেছে সেটাও তিনি মানেন।

সিমলাতে আলোচনার এক ফাঁকে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও প্রেসিডেন্ট ভুট্টো

ছবির উৎস, Getty Images

সার্বিক বিবেচনায় এটা সম্ভবত বলাই যায়, একাত্তরের যুদ্ধের পর এই চুক্তি যেমন সাধারণ ভারতীয়দের মন জয় করতে পারেনি – তেমনি আবার পরাজিত শক্তি পাকিস্তানকেও বেশ অনিচ্ছার সঙ্গেই চুক্তির অনেকগুলো ধারা মেনে নিতে হয়েছিল।

ফলে সিমলা চুক্তি যে দু’পক্ষই পদে পদে লঙ্ঘন করতে পারে – সেই সম্ভাবনা নিহিত ছিল এটির জন্মলগ্নেই।

তক্ষশীলা ইনস্টিটিউশনে পাকিস্তান ডেস্কের গবেষক ঐশ্বরিয়া সোনাভানের কথায়, “ঐতিহাসিকভাবেই কিন্তু পাকিস্তান বারবার এই চুক্তির শর্ত থেকে বিচ্যুত হয়েছে।”

“ভারত আলোচনায় উৎসুক নয়, এই যুক্তি দিয়ে তারা কাশ্মীর ইস্যুতে জাতিসংঘ, ওআইসি বা ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসের মতো অসংখ্য আন্তর্জাতিক ফোরামের দ্বারস্থ হয়েছে।”

ফলে চুক্তি অনুযায়ী যে বিষয়টা ‘দ্বিপাক্ষিক’ থাকার কথা – সেটাতে কিন্তু বারেবারেই তৃতীয় পক্ষকে টেনে আনা হয়েছে এবং তাতে চুক্তিটা ক্রমশ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে।

ঐশ্বরিয়া সোনাভানে আরও মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ২০২১ সালে যে সমঝোতার পর দুই দেশ এলওসি-তে যুদ্ধবিরতি করতে রাজি হয়েছিল, সেই গোপন বৈঠক আয়োজনের ক্ষেত্রে সংযুক্ত আরব আমিরাত বড় ভূমিকা নিয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।

ফলে ভারতও যে কোনও কোনও ক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষের একটা প্রচ্ছন্ন ভূমিকা মেনে নিয়েছে, সে কথা সুবিদিত।

এখন সিমলা চুক্তির ভবিষ্যৎ তাহলে কী?

গত ২৪শে এপ্রিল পাকিস্তানের সর্বোচ্চ সিভিল-মিলিটারি নীতি-নির্ধারণী সংস্থা ‘ন্যাশনাল সিকিওরিটি কমিটি’ (এনএসসি) ঘোষণা করে যে তারা সিমলা চুক্তি-সহ ভারতের সঙ্গে সব দ্বিপাক্ষিক চুক্তিই ‘সাসপেন্ড’ করে দিচ্ছে – মানে চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসছে।

ঠিক তার আগের দিন ভারতের সিন্ধু জল-চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার ঘোষণার জবাবেই যে এই পদক্ষেপ, জানানো হয় সেটাও।

ড: শুভ্রকমল দত্ত

ছবির উৎস, X/Dr SK DUTTA

ভারতের দক্ষিণপন্থী ফরেন পলিসি এক্সপার্ট শুভ্রকমল দত্ত বিবিসিকে বলছিলেন, “একদিকে এতে ভালই হল যে ভারতেরও আর সিমলা চুক্তি মানার কোনও দায় রইল না!”

“চুক্তিটা এমনিতেই অনেক পুরনো, ভারতের স্বার্থও সেভাবে রক্ষিত হয়নি, তার কার্যকারিতাও শেষ হয়ে গেছে বলে মনে করি।”

তিনি মনে করছেন, বাস্তবতা হল এই মুহুর্তে সিমলা চুক্তির তেমন কোনও অস্তিত্ত্ব নেই – এবং ভারতেরও শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ মীমাংসা করতে হবে, এমন কোনও ইচ্ছে নেই।

“অপারেশন সিন্দুর আর সিন্ধু জল-চুক্তি বাতিল করাই দেখিয়ে দিয়েছে, এখন থেকে ভারতের বিরোধ নিরসনের টেমপ্লেট-টা ঠিক কী হবে!”

“বোঝা যাচ্ছে নরেন্দ্র মোদী সরকার স্থির করে নিয়েছে যে পাকিস্তানের সঙ্গে আর কোনও আলোচনা নয়, সামরিক অভিযানই একমাত্র রাস্তা”, বলছিলেন ড: দত্ত।

ভারতীয় বিমানবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা, এয়ার মার্শাল অনিল খোসলা আবার এক ধাপ এগিয়ে মন্তব্য করেছেন, “সিমলা চুক্তি থেকে পাকিস্তানের বেরিয়ে আসার অর্থ হল ভারতকে পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরে হামলা চালানোর খোলাখুলি আমন্ত্রণ জানানো!”

সিমলাতে ভারতের তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী স্বরণ সিং-এর সঙ্গে বেনজির ভুট্টো। জুলাই, ১৯৭২

ছবির উৎস, Getty Images

বিবিসি বাংলায় আরও পড়তে পারেন :

এদিকে গত শনিবার (১০ই মে) মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও তার যে টুইটে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতির কথা ঘোষণা করেন – সেটিতে তিনি এ কথাও জানিয়েছিলেন যে দুই দেশ বিভিন্ন ইস্যুতে একটি ‘নিরপেক্ষ স্থানে’ আলোচনা করতে রাজি হয়েছে।

ভারত ও পাকিস্তান যদি প্রকাশ্যে তৃতীয় কোনও দেশের মাটিতে গিয়ে কাশ্মীর নিয়ে আলোচনা করে, ধরে নেওয়া যেতে পারে সিমলা চুক্তির কফিনে শেষ পেরেকটিও সে দিন পোঁতা হয়ে যাবে।

পরে ভারত অবশ্য রুবিও-র এই দাবি অস্বীকার করেছে, কিন্তু দুই দেশ আসলে ঠিক কী করতে যাচ্ছে এবং কীসে রাজি হয়েছে তা নিয়ে সংশয় কিন্তু দূর হচ্ছে না।

সিমলা চুক্তি সই হওয়ার সময় যে কিশোরী বেনজির ভুট্টো হিমাচলের রাজভবনে উপস্থিত ছিলেন, ২০০৭ সালে পাকিস্তানে ভোটের প্রচারের সময় আততায়ীর হামলার জেরে তিনি প্রাণ হারান।

তিনি নিজে একদা যে ইতিহাস রচনার সাক্ষী ছিলেন, সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ বলছে সেই চুক্তিও এখন ধীরে ধীরে তার ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’র দিকেই এগোচ্ছে!