Home LATEST NEWS bangla সর্বশেষ সংবাদ সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের বিদেশে যাওয়া নিয়ে উত্তাপ, দেশে ফেরার পর আলোচনার...

সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের বিদেশে যাওয়া নিয়ে উত্তাপ, দেশে ফেরার পর আলোচনার অবসান?

3
0

Source : BBC NEWS

সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ

সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ গত মাসের শুরুতে যখন চিকিৎসার জন্য দেশত্যাগ করেন তখন সেটি ঘিরে আন্দোলন এবং অন্তর্বর্তী সরকারের তৎপরতা নানা আলোচনার জন্ম দিয়েছিল।

একজন সাবেক রাষ্ট্রপতি, যিনি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কিশোরগঞ্জের এক হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি, তিনি কীভাবে আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে দেশ ত্যাগ করলেন? কেন তাকে আটকানো হয়নি? সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে এই প্রশ্নগুলো উঠতে শুরু করে।

সে সময় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছিলেন, “দরকার হলে তাকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে ধরে আনা হবে”।

যদি তাদেরকে শাস্তির আওতায় না আনা হয় তাহলে নিজে দায়িত্ব থেকে চলে যাওয়ার কথাও বলেছিলেন তিনি। তবে শেষ পর্যন্ত এক মাসের চিকিৎসা শেষে রোববার রাতে মি. হামিদ দেশে ফিরে আসেন।

চিকিৎসার জন্য তার দেশত্যাগ এবং পরে ফিরে আসা—এই দুই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে আলোচনা তৈরি হয়েছে।

গত ৭ই মে দিবাগত রাতে থাই এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে ব্যাংককের উদ্দেশে দেশ ছাড়েন সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ।

যদিও তিনি চিকিৎসার জন্য যাচ্ছেন বলে জানানো হয়েছিল, বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশ পেতেই দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনসহ সারা দেশের বিভিন্ন মহলে ব্যাপক আলোচনা,সমালোচনা, বিক্ষোভ শুরু হয়।

আরও পড়তে পারেন
আবদুল হামিদের দেশত্যাগ ও দেশে ফেরার ছবি।

ছবির উৎস, Facebook

আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে ‘গণহত্যার’ অভিযোগ এনে দলটিকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ শুরু করে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), ইসলামী ছাত্র শিবির, ইসলামী আন্দোলন, ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দল ও সংগঠন।

প্রথমে কর্মসূচির ডাক দেন এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনা এবং পরে শাহবাগে অবস্থান নেন তিনিসহ অনেকে।

তীব্র জনরোষের মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে তৎপরতা দেখা যায়। প্রথমে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ তুলে কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাসান চৌধুরীকে প্রত্যাহার করা হয়।

এরপর বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনে দায়িত্বে থাকা একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, উপপরিদর্শক ও সহকারী উপপরিদর্শক পদমর্যাদার দুজন কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

যদিও সেই কর্মকর্তারা উর্ধ্বতনদের সম্মতি নিয়েই ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করেছিলেন বলে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে।

আবদুল হামিদের দেশত্যাগের ঘটনা তদন্তে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে সরকার, যার নেতৃত্বে ছিলেন উপদেষ্টা পরিষদের তিন সদস্য।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা সে সময় আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, “সাবেক রাষ্ট্রপতির দেশত্যাগের ঘটনায় জড়িত ও সহায়তাকারীদের শাস্তির আওতায় আনা হবে। ইতিমধ্যে জড়িতদের বরখাস্ত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।”

এরপর আন্দোলনের চাপের মুখে গত ১০ই মে অন্তর্বর্তী সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আওয়ামী লীগ ও দলটির নেতাদের বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই দল এবং দলটির অঙ্গ, সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সব সংগঠনের সব ধরনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

এই সিদ্ধান্ত আসার পর শাহবাগে জড়ো হয়ে উল্লাস করেন আন্দোলনকারীরা। অনেকেই মনে করেন, আবদুল হামিদের দেশত্যাগ ছিল এই সিদ্ধান্তের অন্যতম অনুঘটক।

ছেলের ফেসবুক স্ট্যাটাস।

ছবির উৎস, Facebook/BBC

আলোচনার কেন্দ্রে থাকা আবদুল হামিদ অবশেষে রোববার দিবাগত রাত দেড়টার দিকে ব্যাংকক থেকে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফেরেন। ইমিগ্রেশনের আনুষ্ঠানিকতা শেষে তিনি তিনটার দিকে বিমানবন্দর ছাড়েন।

হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এস এম রাগীব সামাদ গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, তিনি সাধারণ যাত্রীর মতোই এসেছেন, কোনো প্রটোকল চাননি।

বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্র জানায়, উড়োজাহাজ থেকে হুইলচেয়ারে করে আবদুল হামিদকে নামিয়ে আনা হয়। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন ছোট ছেলে রিয়াদ আহমেদ এবং শ্যালক ডা. নওশাদ খান।

তার এই দেশে ফেরা নিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে বলেছেন, “আবদুল হামিদের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট না থাকায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। তদন্ত করার পর যে দোষী প্রমাণিত হবে তাকে আইনের আওতায় নেওয়া হবে।”।

সোমবার ঢাকার যাত্রাবাড়ী থানা পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ”আপনারাই আমাকে রিকোয়েস্ট করেছেন, আপনাদের কথাই আমি রাখছি, আমাদের তদন্ত করতে দেন। যদি তদন্তে কেউ দোষী হয় তাহলে আমরা আইনের আওতায় নিয়ে আসব। প্রমাণিত না হলে কেন একটা নির্দোষ লোককে সাজা দেবো।”

আবদুল হামিদের দেশত্যাগের ঘটনায় যাদের বিরুদ্ধে তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, তাদের বিষয়ে জানতে চাইলে এই উপদেষ্টা বলেন, ”এই ঘটনায় উপদেষ্টাদের তিনজনের একটা কমিটি হয়েছে। উনাদের ওই রিকমেনডেশনটা পাওয়ার পরে দোষী হলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যদি দোষী না হয়, তারা আবার যার যার জায়গায় ফিরে আসবেন।”

বিবিসি বাংলার অন্যান্য খবর:
উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তের কথা জানান আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল

ছবির উৎস, Chief Adviser’s Press Wing

পারিবারিক সূত্রের বরাত দিয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে বলা হয়েছে, আবদুল হামিদ ফুসফুসের টিউমার ও কিডনি জটিলতায় ভুগছেন। এছাড়া তার আরও কিছু শারীরিক জটিলতা রয়েছে। সেসব চিকিৎসার জন্য তিনি থাইল্যান্ডে যান।

আবদুল হামিদের দেশত্যাগ নিয়ে যখন আলোচনা তুঙ্গে তখন তার কনিষ্ঠ ছেলে রিয়াদ আহমেদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বাবার সাম্প্রতিক একটি ছবি ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে আবেগঘণ স্ট্যাটাস লিখেছিলেন।

সেখানে তিনি লিখেন, “বেটার (আরও ভালো) চিকিৎসার জন্য ডাক্তারগণ বোর্ড করে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন বিদেশে চিকিৎসা করানোর জন্য। যিনি রাষ্ট্রপতি হিসেবে মেয়াদ শেষ হবার পর প্রকাশ্যে বলেছেন যে, উনি আর পলিটিক্সের সঙ্গে জড়িত হবেন না এবং তারপর পলিটিক্সের সঙ্গে কোনোভাবে জড়িত হননি। আবার, যেখানে শত শত লোক বাংলাদেশ থেকে চিকিৎসা করাতে নিয়মিত থাইল্যান্ড যাচ্ছে, সেখানে একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে থাইল্যান্ডে চিকিৎসার জন্য তিনি আসতেই পারেন”।

রিয়াদ আহমেদ লিখেন, “অথচ এ ঘটনাটাকেই এত বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে যা কল্পনাতীত। বানিয়ে মিথ্যা বলতে পারাটাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে কিছু লোক। আমি যদি মিথ্যা বলে থাকি তবে আল্লাহর লানত আমার ওপর পরুক। আর যারা মিথ্যা প্রচার করছে তারা যদি তাদের কৃতকর্মের জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে তওবা না করে তবে তাদের সবার ওপর আল্লাহর লানত পরুক”।

কিশোরগঞ্জে গত ৪ঠা আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে মিছিলে গুলিবর্ষণ, হামলা ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানা, ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, আওয়ামী লীগ নেতা ওবায়দুল কাদেরসহ ১২৪ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত আরও ২৫০ জনের নামে মামলা হয়।

গত ১৪ই জানুয়ারি কিশোরগঞ্জ সদর থানায় দায়ের হওয়া এই মামলায় সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদেরও নাম রয়েছে।

লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, ”সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের দেশ ছাড়ার বিষয়ে সরকার ও তাদের ঘনিষ্ঠ মহলগুলো যে আচরণ দেখিয়েছে তা কাণ্ডজ্ঞানহীন ও অপরিপক্ক কারণ তিনি চিকিৎসার জন্য বিদেশ গিয়েছিলেন এবং এটা সরকার অবগত ছিল। তারপরেও বিষয়টি নিয়ে নিয়ে যে উত্তাপ ছড়ানো হয়েছিল তার শিশুসুলভ আচরণের বহিঃপ্রকাশ।”

আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের প্রজ্ঞাপন।

গত বছরের ৫ই অগাস্ট ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগের পতন হলে দলটির অনেক নেতাকর্মী দেশ ছাড়লেও আবদুল হামিদ দেশে অবস্থান করছিলেন।

সরকার পতনের প্রায় নয় মাস পর চিকিৎসার জন্য ব্যাংককের উদ্দেশে দেশ ছাড়েন তিনি। প্রায় এক মাস চিকিৎসা শেষে তিনি দেশে ফেরেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সাব্বির আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, ”সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ যে প্রক্রিয়ায় বিদেশে গিয়েছেন এবং যে প্রক্রিয়ায় ফিরে এসেছেন সে সব বিষয়ে সরকার অবগত ছিল। এই স্বাভাবিক বিষয়টিকে নিয়ে যেভাবে চতুর্দিকে শোরগোল তৈরি করা হয়েছে, এটা হুজুগে মেতে ওঠার মত।”

”যারা সে সময় তার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন তারা এখন তাদের বক্তব্যের অসরতা বুঝতে পারছেন। সরকার জানতেন যে তিনি দেশ ছাড়বেন জেনেও সরকার ইনটেনশনালি আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের ঘটনাটা ঘটিয়েছে। তার দেশ ছাড়াকে এক্সকিউজ হিসেবে নিয়ে এই ঘটনা হয়তো ঘটানো হয়েছে,” তিনি বলেন।

আবদুল হামিদ আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১৩ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত টানা দুই মেয়াদে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

তার আগে তিনি নবম জাতীয় সংসদের স্পিকার হিসেবে ২০০৯ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত মেয়াদে ডেপুটি স্পিকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

আবদুল হামিদ ‌ব্যক্তি হিসেবে ১৭তম রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তার মেয়াদ শেষে ২০২৩ সালের ২৪শে এপ্রিল রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন বর্তমান মো. সাহাবুদ্দিন।

বঙ্গভবন ছাড়ার পর আবদুল হামিদ বর্তমানে ঢাকার নিকুঞ্জ এলাকায় বসবাস করছেন।