Home LATEST NEWS bangla সর্বশেষ সংবাদ রাশিয়ায় ‘কাজ করতে গিয়ে যুদ্ধে জড়িয়ে’ বাংলাদেশির মৃত্যু, মরদেহ ফেরত চায় পরিবার

রাশিয়ায় ‘কাজ করতে গিয়ে যুদ্ধে জড়িয়ে’ বাংলাদেশির মৃত্যু, মরদেহ ফেরত চায় পরিবার

5
0

Source : BBC NEWS

আকরাম হোসেন

ছবির উৎস, Familly handout/Ujjal Chakraborty

৬ মিনিট আগে

রাশিয়ার পক্ষে যুদ্ধ করতে ইউক্রেন গিয়েছিলেন বাংলাদেশি আকরাম হোসেন। এই যুদ্ধেই প্রাণ হারান ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জের ওই যুবক। এখন তার মরদেহ দেশে ফেরত আনার দাবি জানাচ্ছে তার পরিবার।

নিহতের বাবা মোরশেদ মিয়া বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “টাকার অভাব মেটাতে ভিনদেশে যুদ্ধে গিয়ে ছেলের প্রাণ যাবে এটা কল্পনাও করতে পারছেন না” তারা।

তিনি বলেন, “জানি ছেলেকে ফিরে পাবো না, তবে আমার ছেলের লাশটা যেন ফিরিয়ে দেয়া হয়। আমি নিজের ছেলেকে নিজ হাতে মাটি দিতে চাই।”

আকরামের পরিবারের সদস্যরা তার মরদেহ দেশে ফেরাতে সরকারের সহযোগিতা চাচ্ছেন, তারা শিগগিরই এ বিষয়ে সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করবেন।

এই তথ্য জানিয়ে মোরশেদ মিয়া বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, তার ছেলে মূলত চীনের একটি কোম্পানিতে কাজের উদ্দেশ্যে রাশিয়ায় গিয়েছিল। পরে তাকে একটি চক্র টাকার বিনিময়ে কিনে নিয়ে একটি কাগজে স্বাক্ষর করিয়েছে। একই সাথে তাকে (আকরাম) রাশিয়ার নাগরিকত্ব দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে যুদ্ধে নেয়া হয়েছে।

এমন অবস্থায় আকরাম নিহত হওয়ার পর তার মরদেহ দেশে আনা সম্ভব কি-না সেটি নিয়েও প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। যদিও স্থানীয় প্রশাসন বলছে, মরদেহ দেশে আনতে পরিবারকে যে কোনো ধরনের সহযোগিতার জন্য প্রস্তুত রয়েছে সরকার।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাফে মোহাম্মদ ছড়া বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “যিনি নিহত হয়েছেন তার মরদেহ বর্তমানে কোথায় আছে সেটি জানতে হবে। পরবর্তীতে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ফেরত আনার উদ্যোগ নিতে উপজেলা প্রশাসন নিহতের পরিবারকে সহযোগিতা করতে চায়।”

এ নিয়ে আরো পড়তে পারেন
রুশ সৈন্য, ফাইল ছবি

ছবির উৎস, Getty Images

যেভাবে রাশিয়ায় গিয়েছিলেন আকরাম

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জের আকরাম হোসেনের বয়স ২৫ বছর। পরিবারের খরচে নরসিংদীর একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে ওয়েল্ডারের কাজ শেখেন তিনি।

পরে স্বজনের কাছ থেকে ঋণ করে প্রায় ৯ মাস আগে আকরামকে রাশিয়া পাঠান তার বাবা মোরশেদ মিয়া।

“আমি গরীব মানুষ, কৃষি কাজ করি। ছেলেকে ভালো ওয়েল্ডিংয়ের কাজ শিখিয়ে বিদেশ পাঠাইতে চাইছি, শিখছেও। পরে চায়না কোম্পানিতে জয়েন করার কথা,” মোরশেদ মিয়া বিবিসি বাংলাকে বলেন।

“রাশিয়ায় যাওয়ার পর চায়না কোম্পানিতে চার মাস আমার পুতে কাজ করছে। সেখানে ওয়েল্ডার হিসেবে গেছে। কিন্তু ওয়েল্ডার হিসেবে না দিয়া তাকে হেলপার হিসাবে ছয়শো টাকা বেতনে কাজ দেয়া হয়েছে।”

পরিবারের দাবি, যে চার মাস রাশিয়ায় চীনা একটি কোম্পানিতে কাজ করতেন আকরাম, সেখান থেকে নিয়মিত বেতনভাতা দেয়া হতো না। খাওয়া নিয়েও ছিল সংকট।

নিহত আকরামের বাবা জানান, মূলত ওয়েল্ডার হিসেবে যাওয়ার পর সহযোগী হিসেবে কাজ করতে দেয়া এবং বেতন কম দেয়ার কারণে ওই চাকরিতে অনীহা তৈরি হয় তার।

“ঠান্ডা ও বরফের মধ্যে কাজ করতে দেয়া হতো। ঠিকমতো বেতন দিতো না, ভাত দিতো না, রাশিয়ান খাবার দিতো,” বলছিলেন আকরামের পিতা মি. মিয়া।

ইউক্রেনের লুহানস্ক অঞ্চলে সরকারি বাহিনীর পাল্টা আক্রমণের প্রস্তুতি

ছবির উৎস, Getty Images

প্রলোভনে পড়ে রুশ যোদ্ধা?

রাশিয়ায় চীনা কোম্পানিতে কাজ করার পর সেখানকার একটি গ্রুপের সঙ্গে আকরামের পরিচয় হয় বলে তার বাবা মোরশেদ মিয়া জানান।

“ওই গ্রুপের একজন লোক আকরামসহ সাতজন বাঙালি ছেলেকে রাশিয়ার মস্কো নিয়ে যায়। সেখানকার সেনাবাহিনীর মাধ্যমে কিছুদিন ট্রেনিংও দেয়া হয়। পরে সেখান থেকে তাদেরকে যুদ্ধের জন্য নিয়ে যাওয়া হয় ইউক্রেন।”

আকরামের বাবা আরও বলেন, “আমি যখন জানতে পারলাম, ছেলেরে জিগাইলাম কেমনে কী গেলি ইউক্রেন? তখন ছেলে আমারে জানাইলো আমারে এদেশের নাগরিকত্ব দিবে এবং দুই বিলিয়ন টাকাও দিবে রাশিয়া সরকার।”

“আমার ছেলেডারে লোভ-লালসা দেখাইয়া ওরা ইউক্রেনের যুদ্ধে নিয়া গেছে দালাল চক্র,” যোগ করেন তিনি।

গত দুই মাসে বেশ কিছুদিন পরপর অল্প সময়ের জন্য পরিবারের সাথে ফোনে কথা বলতেন আকরাম। তখন সেখানকার ভীতিকর পরিবেশে থাকা ও যুদ্ধের সেই অভিজ্ঞতার কথাও পরিবারকে জানাতেন তিনি। এ সময় যুদ্ধের পোশাক পরা নিজের কিছু ছবিও পরিবারের কাছে পাঠান তিনি।

মোরশেদ মিয়া বিবিসি বাংলাকে বলেন, “যুদ্ধে একেকটা বাংকারে মোট ১২ জন করে যোদ্ধা থাকতো। একটা বাংকারে রুশ সেনাবাহিনীর নয়জন আর আমার ছেলেসহ তিনজন বাঙালি ছিল।”

যুদ্ধের এই ভয়াবহতা দেখে আকরাম এতটা ভয় পেয়েছিলেন যে কান্নাকাটি করে দেশে ফিরতে চাইতেন, কিন্তু একটি কাগজে চুক্তি করার কারণে সেখান থেকে ফেরার কোনো উপায় ছিল না, জানান তার বাবা।

“আমি তারে আশ্বাস দিয়েছিলাম ছেলেরে যেকোনো উপায়ে দেশে ফেরাবো। কিন্তু তা তো আর হইলো না,” কান্নাজড়িত কণ্ঠে বিবিসিকে বলছিলেন মোরশেদ মিয়া।

পরিবার জানায়, গত ১৩ই এপ্রিলের পর থেকে তারা আর কোনো যোগাযোগ করতে পারেনি আকরামের সঙ্গে। সর্বশেষ ওইদিনই আকরাম জানিয়েছিল সেখানকার যুদ্ধ পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে।

১৮ই এপ্রিল শুক্রবার তার সহযোদ্ধা পরিচয়ে একজন আকরামের পরিবারকে ফোন করে জানান, ইউক্রেন সেনাবাহিনীর মিসাইল হামলায় আকরাম নিহত হয়েছেন। একই সাথে আকরামের ইউনিটের আরও কয়েকজন মারা গেছেন।

পরিবার থেকে আকরামের নম্বরে যোগাযোগ করেও আর তাকে পাওয়া যায়নি।

মোরশেদ মিয়া জানান, যুদ্ধে অংশ নেয়া বাবদ আকরামকে এ পর্যন্ত চার লাখ রুবল (রাশিয়ান মুদ্রা, ১ রুবল সমান ১ টাকা ৪৮ পয়সার কাছাকাছি) দেয়া হয়েছিল তারা অ্যাকাউন্টে। যদিও সে টাকা আর তুলতে পারেনি আকরাম হোসেন।

বিবিসি বাংলার অন্যান্য খবর

মরদেহ ফেরানো যাবে?

ছেলের মৃত্যুর খবর পেয়ে আকরামের বাবা মোরশেদ মিয়া আশুগঞ্জ থানা পুলিশ ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করেন।

উপজেলা প্রশাসন ও সরকারের কাছে ছেলে লাশ দেশে আনার ব্যাপারে যোগাযোগও করেন মোরশেদ মিয়া।

তিনি বলেন, “আমার একটা মাত্র ছেলে। ছেলেকে আর জীবিত ফেরত পাবো না। ছেলের লাশটা আমি ফেরত চাই। এর জন্য যা যা করার আমি করতে চাই।”

তবে বিবিসি বাংলার কাছে দেয়া সাক্ষাৎকারে মোরশেদ মিয়া এটিও বলেছেন যে তার ছেলে রুশ বাহিনীর সাথে যুদ্ধে যোগ দেয়ার কারণে কিছু আইনি জটিলতা থাকতে পারে। তবে সরকারি উদ্যোগে চেষ্টা করা হলে হয়তো ফেরানো সম্ভব।

মোরশেদ মিয়া বলেন, “শুধু আমার ছেলে না। এই দেশে থেকে যারা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে গেছে, মৃত্যু বা জীবিত অবস্থায় তাদের সবাইকে যেন দেশে ফেরত আনা হয় সেই দাবি আমি সরকারের কাছে জানাই।”

রোববার ছেলেকে দেশে ফেরত আনতে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে যোগাযোগ করবেন বলে জানান নিহতের পিতা।

আশুগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নির্বাহী কর্মকর্তা রাফে মোহাম্মদ ছড়া বিবিসি বাংলাকে জানান, মরদেহ ফেরত আনার কাজটি মূলত প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের। আকরামের মরদেহ ফেরত আনতে কী করা যায় সেটি নিয়ে এরই মধ্যে মন্ত্রণালয়ের সাথে উপজেলা প্রশাসনের সাথে কথা হয়েছে।

এর আগে বাংলাদেশের কয়েকটি গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে যেখানে বলা হয়, রাশিয়ার যুদ্ধে বাংলাদেশিদের অংশগ্রহণের তথ্য পাওয়া গেছে এবং এক বাংলাদেশির মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বিবিসি বাংলাকে বলেন, “যেসব কর্মীদের পড়াশোনা ও দক্ষতা কম তারা মোটামুটি দালালনির্ভর হয়েই বিদেশ যায় এবং সেখানে গিয়েও প্রতারণার শিকার হয়। রাশিয়ার ক্ষেত্রে এর আগেও এমন ঘটনা দেখেছি।”

যুদ্ধপ্রবণ দেশগুলোয় কর্মী পাঠানোর আগে সরকার সঠিকভাবে যাচাই বাছাই না করে তাদের যাওয়ার সুযোগ দেয়ার কারণেই এসব ঘটনা ঘটছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

আসিফ মুনীর বলেন, রাশিয়া, লিবিয়ার পাশাপাশি অন্য যে সব দেশে গেলে জীবনের ঝুঁকি থাকে সেসব দেশে যাওয়ার অনুমোদন দেয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ সচেতনতা জরুরি এবং এর জন্য জবাবদিহিতা তৈরি করতে হবে।