Home LATEST NEWS bangla সর্বশেষ সংবাদ রাজনৈতিক দলের সংস্কার ইস্যু কি চাপা পড়ে গেলো?

রাজনৈতিক দলের সংস্কার ইস্যু কি চাপা পড়ে গেলো?

3
0

Source : BBC NEWS

বাংলাদেশের  রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে গণতন্ত্র চর্চা নেই বলে অভিযোগ দীর্ঘদিনের

ছবির উৎস, Getty Images

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো সংবিধানসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে ব্যাপক তৎপরতা দেখালেও নিজেদের দলীয় সংস্কার কিংবা দলের মধ্যে গণতন্ত্র নিশ্চিত করার কোনো কার্যকর প্রক্রিয়া নিয়েছে, এমনটি দেখা যাচ্ছে না।

বড়-ছোট বেশিরভাগ দলই কার্যত তাদের শীর্ষ নেতার একক নিয়ন্ত্রণ ও ইচ্ছায় পরিচালিত হচ্ছে বলেই দৃশ্যত প্রতীয়মান হয়, যদিও সব দলই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পরিচালিত হওয়ারই দাবি করে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, ২০০৭ সালে ১/১১ -এর সময় থেকে রাজনৈতিক দলের সংস্কারের আলোচনা শক্তভাবে উঠলেও দলগুলোর অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিতে কার্যত কোনো পরিবর্তন আসেনি।

“দলগুলো নিজেরা নির্বাচন চায়, কিন্তু দলের ভেতরের নেতৃত্ব নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আনতে চায় না। ব্যক্তি ও পরিবারকেন্দ্রিক সিন্ডিকেটের হাতেই দলের মধ্যকার আকাঙ্ক্ষিত সংস্কার আটকে আছে,” বিবিসি বাংলাকে বলছেন তিনি।

যদিও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলছেন, সংস্কার বলতে যদি দলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার কথা বোঝানো হয় সেই চর্চা তারা করছেন।

“এটি চলমান প্রক্রিয়া। তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত এই চর্চার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে,” বিবিসি বাংলাকে বলেছেন তিনি।

অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর মুখপাত্র মতিউর রহমান আকন্দও বলছেন, তাদের দলে নেতৃত্ব নির্বাচন থেকে শুরু করে সব প্রক্রিয়াতেই গণতান্ত্রিক রীতিনীতি অনুসরণ করা হয়।

“কিন্তু অনেকে দলেই এটি নেই। সব দল এই চর্চা করলে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রেও তার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে,” বলছিলেন তিনি।

বিবিসি বাংলায় আরও পড়ুন:
লন্ডনে অবস্থানরত তারেক রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছে বিএনপি

ছবির উৎস, BNP MEDIA CELL

কিন্তু দলের সংস্কার কি আলোচনায় আছে?

ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম শুক্রবার ‘রাজনৈতিক দলে সংস্কারের জরুরি আলাপ কেউই করছে না’ শীর্ষক এক লেখায় লিখেছেন “…একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার এখনও আলোচনার বাইরে। সেটা হলো, রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার”।

তার মতে, “আমাদের গণতন্ত্র ও সুশাসনে দুরবস্থার অন্যতম প্রধান কারণ রাজনৈতিক দলগুলোর, বিশেষত দলগুলোর শীর্ষ নেতৃত্বে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র ও জবাবদিহিতার অভাব”।

এই লেখাতেই মি. আনাম বিএনপির গঠনতন্ত্রে চেয়ারপার্সনের প্রশ্নাতীত ক্ষমতা এবং ওই গঠনতন্ত্রে চেয়ারপার্সনের একচ্ছত্র ক্ষমতা দেয়ার কারণে যে তিনি কারও কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নন-এই প্রসঙ্গও উল্লেখ করেছেন।

এর আগে গত ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগেও দলটির সভানেত্রী শেখ হাসিনার একক ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রতিফলনই ঘটতে দেখা গেছে।

বাংলাদেশে গত বছর পাঁচই অগাস্টের আগ পর্যন্ত প্রধান দুই রাজনৈতিক দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগে তাদের দুই শীর্ষ নেতাই ছিলেন শেষ কথা। খালেদা জিয়ার জেল ও অসুস্থতার কারণে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে তারেক রহমানের হাতেই এখন একচ্ছত্র ক্ষমতা।

দলের নেতারা প্রকাশ্যে স্বীকার না করলেও এটিই বাস্তবতা যে দলটি পরিচালিত হচ্ছে তারেক রহমানের ইচ্ছেতেই। প্রায় নয় বছর দলটির কোনো সম্মেলনও হয়নি। প্রায় সাত বছর পর দলটির বর্ধিত সভা হয়েছে চলতি বছর ফেব্রুয়ারিতে।

তবে শেখ হাসিনার পতনের পর দলের কিছু ইউনিটে ভোটের মাধ্যমে নেতা নির্বাচনের উদ্যোগ দেখা গেছে।

খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়কার নিপীড়ন নির্যাতনের কারণে চরম প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তারা দলের কোনো কার্যক্রমই ঠিকমতো করতে পারেননি।

“এখন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান উদ্যোগ নিয়েছেন এবং দলের প্রতিটি স্তরে গণতান্ত্রিক চর্চার উদ্যোগ নিয়েছেন, যা চলমান আছে,” বিবিসি বাংলাকে বলেছেন তিনি।

সংবিধানসহ বিভিন্ন ইস্যুতে সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা এখন চলমান আছে

ছবির উৎস, CHIEF ADVISER’S PRESS WING

জামায়াতে ইসলামীতে নেতৃত্ব নির্বাচনের মাধ্যমে ঠিক হয় বলে দলের নেতারা দাবি করলেও এসব কার্যক্রম প্রকাশ্যে হয় না বলে দলের বাইরে থেকে সেগুলো পর্যবেক্ষণ করা কঠিন।

যদিও দলটির মুখপাত্র মতিউর রহমান আকন্দ বলছেন, দলের কেন্দ্র থেকে শুরু করে সব ইউনিটেই নেতৃত্ব নির্বাচন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় কোনো ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীলতা নেই।

“গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াতেই দল পরিচালিত হয়। অন্য দলগুলোতে বরং সেটি আমরা দেখি না,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

এর বাইরে জাতীয় পার্টিতে জি এম কাদেরই এখন একমাত্র নেতা। তিনিই ঠিক করেন দলের কোথায় কোন পদে কোন নেতা থাকবে। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোসহ ছোট বড় অন্য দলগুলোর অবস্থাও অনেকটাই একই।

নবগঠিত দলগুলোর মধ্যে আলোচনায় জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) চলছে আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে। তারা এখনও তাদের গঠনতন্ত্রও চূড়ান্ত করতে পারেনি। এছাড়া বাম রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সিপিবি ছাড়া বাকিরা সবাই ‘নেতা পরিচালিত’ সংগঠনের মতো করেই চলছে।

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক অবশ্য বলছেন, সংস্কারের বিষয়ে দলগুলোর মধ্যে কিছু উপলব্ধি আছে বলেই তিনি মনে করেন।

“দলের গঠনতন্ত্র ও পরিচালনায় সংস্কার না হলে রাষ্ট্র সংস্কার টেকসই হবে না। গণতন্ত্র ও দলে নেতাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিতের একটা তাগিদও আছে। এই উপলব্ধি আমি দেখছি। হয়তো কিছুটা সময় লাগবে। দেশের বাস্তবতার কারণেই হয়তো একবারেই সব হবে না,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন তিনি মনে করেন, এ দেশের দলগুলো এখনও রাজনৈতিক দলই হয়ে উঠতে পারেনি।

“মানুষের মধ্যে ১/১১ তে রাজনৈতিক দলের সংস্কার নিয়ে যে আকাঙ্ক্ষা দেখেছি, পরিস্থিতি এখনও সেখানেই আছে। একেক দল ব্যক্তি বা পরিবারকেন্দ্রিক সিন্ডিকেট। প্রভাব-প্রতিপত্তি ও শাসন বজায় রাখতে তারা সংস্কার চায় না কিংবা চাইবে না।”

মি. আহমেদ বলেন, দলগুলো নির্বাচন চায়, কিন্তু নেতৃত্ব নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আসে না।

“এ অবস্থা চলছে দিনের পর দিন। দলের মধ্যে এক দল কৃতদাস-সুলভ মনোভাব নিয়ে এগুলো সমর্থন করে থাকে।”

অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে

ছবির উৎস, CA PRESS WING

১/১১, সংস্কার ও পরিবর্তন

বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলে সংস্কারের বিষয়টি জোরেশোরে উঠে এসেছিলো ২০০৭ সালে রাজনৈতিক সহিংসতার জের ধরে ক্ষমতায় আসা সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে।

তখন সরকার ও নির্বাচন কমিশন দল পরিচালনায় স্বচ্ছতা ও গঠনতন্ত্রকে আরও গণতান্ত্রিক করতে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলো।

বিশেষ করে দলীয় কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী, নির্বাচনি হলফনামায় আটটি ব্যক্তিগত তথ্য দেয়া, দলের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা, বিভিন্ন নির্বাচনে প্রার্থিতার জন্য তৃণমূলের ভোটে প্যানেল প্রস্তুত করার ব্যাপারে সুস্পষ্ট বিধান রাখা কিংবা দলের আর্থিক হিসাব-নিকাশ নির্বাচন কমিশনকে দেয়ার মতো কিছু বিষয় চালু হয়েছিলো।

মূলত ২০০৭ সালের শেষের দিকে নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজসহ সংশ্লিষ্ট অনেকের সাথে মতবিনিময়ের মাধ্যমে কিছু বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পেরেছিলো। এর মাধ্যমেই তখন রাজনৈতিক দলগুলোকে নিবন্ধনের মাধ্যমে একটি আইনি কাঠামোতে আনা সম্ভব হয়েছিলো।

সেখানে তখন দল গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত না হলে বা নিবন্ধনের শর্ত পূরণ না হলে নিবন্ধন বাতিলের ক্ষমতাসহ একটি অধ্যাদেশও জারি হয়েছিলো।

যদিও পরবর্তীতে অনেক দলই শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রকে সচেতনভাবে দূরে সরিয়ে রেখেছে এবং ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি কার্যকর করেনি। আর দলের আয়-ব্যয়ের হিসাব কোনো রাজনৈতিক দল সততার সাথে দেয় কি-না তা নিয়েও প্রশ্ন আছে।

আবার কোনো কোনো রাজনৈতিক দল কাউন্সিল করলেও শেষ পর্যন্ত নেতা নির্বাচনের ক্ষমতা দেয়া হয় শীর্ষ নেতৃত্বকে। নির্বাচনকালে প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রেও দেখা যায় শীর্ষনেতার ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রতিফলন।

মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ও নির্বাচন কমিশন দৃঢ়তা দেখালে রাজনৈতিক দলগুলোতে গণতন্ত্রায়ণ অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হতে পারে বলে তিনি মনে করেন।