Source : BBC NEWS

ছবির উৎস, John Barnett
১৭ জুন ২০২৫, ১২:২৫ +০৬
“আমি এমন কোনো ড্রিমলাইনার দেখিনি যেটাকে আমি নিরাপদ বলতে পারি।”- এই কথাটা বলেছিলেন বোয়িং এর সাবেক কোয়ালিটি ম্যানেজার জন বার্নেট।
এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট এআই১৭১ ফ্লাইট দুর্ঘটনার পর থেকে এই ব্যক্তির নাম আবারও আলোচনায়।
কারণ, বোয়িং এর মানহীন বিমান তৈরির তথ্যের হুইসেল ব্লোয়ার ছিলেন এই জন বার্নেট।
জন বার্নেট ৩০ বছরেরও বেশি সময় বোয়িং এ কর্মরত ছিলেন।
তিনি ছিলেন বোয়িং এর একজন দক্ষ কর্মী। ২০১০ সাল থেকে বোয়িং-এর সাউথ ক্যারোলিনার নর্থ চার্লসটন প্ল্যান্টে কোয়ালিটি ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতেন।
এই প্ল্যান্টেই তখন ৭৮৭ ড্রিমলাইনার তৈরি হতো।
বার্নেট জানিয়েছিলেন, ২০১০ সাল থেকেই বোয়িং কর্মীদের উড়োজাহাজ তৈরির সময় নিম্নমানের যন্ত্রাংশ ব্যবহার করতে বাধ্য করা হতো।
বোয়িংয়ের ‘৭৮৭ ড্রিমলাইনার’ নামের এই অত্যাধুনিক বিমান তৈরির সময় তিনি দেখতে পেলেন ভয়ঙ্কর কিছু চিত্র।
ত্রুটিপূর্ণ পার্টস, স্ক্র্যাপ থেকে তোলা উপকরণ, এমনকি সেফটি টেস্টে ফেল করা যন্ত্রাংশ পর্যন্ত লাগানো হচ্ছে বিমানে।

ছবির উৎস, Getty Images
দক্ষিণ ক্যারোলিনায় কাজ শুরু করার পর থেকেই বার্নেট লক্ষ্য করেন যে, নতুন উড়োজাহাজ তৈরির সময়সীমা পূরণের তাড়াহুড়োয় যন্ত্রাংশ লাগানোর ক্ষেত্রে নিরাপত্তা ব্যবস্থার সঙ্গে আপস করা হচ্ছে।
তিনি অভিযোগ করেন, কখনও কখনও উৎপাদন সময় মতো শেষ করার জন্য স্ক্র্যাপ বিন থেকে নিম্নমানের যন্ত্রাংশ নিয়ে উড়োজাহাজে লাগানো হয়েছে, যা মারাত্মক দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে।
তিনি এই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ম্যানেজারকে জানালেও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
বোয়িং ৭৮৭ কারখানার ইঞ্জিনিয়াররাও সমস্যাগুলো রিপোর্ট না করার জন্য চাপ দিতেন বলে বার্নেট দাবি করেন।
তার মূল অভিযোগ ছিল উড়োজাহাজের অক্সিজেন ব্যবস্থাপনা নিয়ে।
তিনি সতর্ক করে বলেছিলেন যে, জরুরি অবস্থায় প্রতি চারটি অক্সিজেন মাস্কের মধ্যে একটি সঠিকভাবে কাজ করে না।
তাঁর মতে, ত্রুটিপূর্ণ অক্সিজেন ব্যবস্থার কারণে ৩৫,০০০ ফুট উচ্চতায় এক মিনিটেরও কম সময়ে যাত্রীরা অজ্ঞান হয়ে যেতে পারেন, এমনকি ৪০,০০০ ফুট উচ্চতায় মাত্র ২০ সেকেন্ডের মধ্যে এটি ঘটতে পারে, যা মস্তিষ্কের স্থায়ী ক্ষতি বা মৃত্যুও ঘটাতে পারে।
আর তার মতে, এইসব কিছুই হচ্ছিল একটাই কারণে – সময়ের মধ্যে প্রোডাকশন শেষ করতে হবে।
সেফটি বা নিরাপত্তা? সেটা ছিল তালিকার একেবারেই নিচের দিকে।
জন বার্নেট এ অন্যায় মেনে নিতে পারেননি। প্রথমে তিনি কোম্পানির ভেতরে প্রতিবাদ করেছিলেন, রিপোর্ট করেছিলেন উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে।
কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। উল্টো তার ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়।
স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে ২০১৭ সালে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন তিনি।
তাঁর অভিযোগ ছিল, বোয়িং এর সঙ্গে বিরোধের জেরে তাঁকে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়েছে এবং তাঁর কর্মজীবনে বাধা সৃষ্টি হয়েছে।
কিন্তু অবসরও দমাতে পারেনি তাকে।
২০১৯ সালে, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (FAA) এবং অফিস অফ স্পেশাল কাউন্সিলে অভিযোগ করেন।
কোথাও থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া না পেয়ে ২০২১ সালে তিনি নিজেই সংস্থার বিরুদ্ধে মামলা করেন।
২০২৪ সালের মার্চ মাস। একটি গুরুত্বপূর্ণ আদালতের শুনানি ছিল সে মাসে।
কিন্তু শুনানির আগের দিন, ১১ই মার্চ দক্ষিণ ক্যারোলিনার একটি পার্কিং লটে জন বার্নেটের মরদেহ পাওয়া যায় তার গাড়ির ভেতরে।
তদন্তকারীরা জানান, তিনি আত্মহত্যা করেছেন।
কিন্তু তার পরিবার এই দাবি মানতে রাজি ছিল না এবং বোয়িংয়ের বিরুদ্ধে মানসিক নির্যাতনের অভিযোগে নতুন করে মামলা করে তারা।
এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট এআই১৭১ দুর্ঘটনার পর জন বার্নেটের আগের অভিযোগগুলো আবার আলোচনায় এসেছে।
যেখানে বোয়িং ড্রিমলাইনার ৭৮৭-৮ মডেলের একটি উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে একজন বাদে ২৪২ আরোহীর সবাই নিহত হন।
বিমানটি যে ভবনে আছড়ে পড়ে সেখানকার বাসিন্দা ছাড়াও ভূমিতে থাকা আরও অন্তত ২৯ জন নিহত হয়েছেন এ দুর্ঘটনায়।
বিষয়টি এখন বিমান নিরাপত্তা আর যেসব কোম্পানি বিমান বানায়, তাদের দায়িত্ব নিয়েও প্রশ্ন তুলছে।
এই দুর্ঘটনার আসল কারণ খুঁজে বের করতে বার্নেটের অভিযোগগুলো কতটা গুরুত্ব পায়, সেটা এখন দেখার বিষয়।