Home LATEST NEWS bangla সর্বশেষ সংবাদ বুরকিনা ফাসোর সেনাশাসক ইব্রাহিম ট্রায়োরে কীভাবে বিশ্বের বহু দেশের মানুষের হৃদয় জিতে...

বুরকিনা ফাসোর সেনাশাসক ইব্রাহিম ট্রায়োরে কীভাবে বিশ্বের বহু দেশের মানুষের হৃদয় জিতে নিয়েছেন

3
0

Source : BBC NEWS

আফ্রিকার বাইরেও অনেক দেশে ইব্রাহিম ট্রায়োরের এই ভাবধারা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে

ছবির উৎস, Ibrahim Traoré/X

৩ ঘন্টা আগে

বুরকিনা ফাসো’র ৩৭ বছর বয়সী ক্যারিশমাটিক নেতা ক্যাপ্টেন ইব্রাহিম ট্রায়োরে গত কয়েক বছরে সমগ্র আফ্রিকার নেতা হিসেবে নিজের ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন তার দেশ সহ ঐ অঞ্চলের বেশকিছু দেশের মানুষের মধ্যে। পশ্চিম আফ্রিকার দেশ বুরকিনা ফাসোকে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ ও নব্য-উপনিবেশবাদের ধারণা থেকে মুক্ত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এই সেনাশাসক।

আফ্রিকার বাইরেও অনেক দেশে ইব্রাহিম ট্রায়োরের এই ভাবধারা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তার সমর্থকরা তাকে ‘আফ্রিকার চে গেভারা’ নামে পরিচিত বুরকিনা ফাসোর মার্ক্সিস্ট বিপ্লবী নেতা থমাস সাঙ্কারার উত্তরসূরি হিসেবে মনে করেন।

“ট্রায়োরের প্রভাব ব্যাপক। আমি কেনিয়ার রাজনীতিবিদ আর লেখকদের বলতে শুনেছি যে তারা বলছেন: ‘আমরা এতদিন পর কাঙ্ক্ষিত নেতা পেয়েছি,” বিবিসিকে বলছিলেন আন্তর্জাতিক কনসালটেন্সি ফার্ম কন্ট্রোল রিস্কস এর সিনিয়র গবেষক বেভারলি ওচিয়েং।

“অনেক আফ্রিকানই এখন আফ্রিকার সাথে পশ্চিমা দেশগুলোর সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন করছেন। তাদের জিজ্ঞাসা, বিপুল মাত্রায় সম্পদ থাকার পরও কেন আফ্রিকা মহাদেশ এখনো চরম দারিদ্র্যের মধ্যে রয়েছে। আর আফ্রিকানদের এই মনোভাবই প্রতিধ্বনিত হয় ইব্রাহিম ট্রায়োরের কার্যক্রমে, বার্তায়”, বলছিলেন তিনি।

সেনা অভ্যুত্থানে ২০২২ সালে ক্ষমতা গ্রহণ করার পর ট্রায়োরের সরকার সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তি ফ্রান্সের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক দৃঢ় করেছে। বুরকিনা ফাসোতে বামপন্থী অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়ন ও রাশিয়ার প্যারা মিলিটারি ব্রিগেড মোতায়েনের মত সিদ্ধান্তের মাধ্যমেই তা অনেকটা পরিষ্কার হয়।

আরো পড়তে পারেন:
গবেষণা বলছে, পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্রের জনপ্রিয়তা বর্তমানে কমছে আফ্রিকার অনেক দেশে

ছবির উৎস, AFP

বিপুল পরিমাণ খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ বুরকিনা ফাসোর বেশ কয়েকটি স্বর্ণের খনি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাত থেকে রাষ্ট্রীয় মালিকানার অধীনে নিয়ে এসেছেন মি. ট্রায়োরের সেনা সরকার।

গত মাসে তারা ঘোষণা দিয়েছে যে বিদেশি মালিকানাধীন আরো খনি রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।

রাষ্ট্রীয় নীতিতে এই ধরনের আমূল পরিবর্তন আনার কারণেই আফ্রিকায় মি. ট্রায়োরের জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে বলছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার ইন্সটিটিউট ফর সিকিউরিটি স্টাডিজের গবেষক এনোখ র‍্যান্ডি আইকিন্স।

“তাকে এখন আফ্রিকার সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট বললে খুব একটা ভুল বলা হবে না”, বলছিলেন মি. আইকিন্স।

সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারণার ফলে তার জনপ্রিয়তা আরো বেড়েছে।

গবেষক বেভারলি ওচিয়েংয়ের মতে ট্রায়োরে প্রথম আফ্রিকানদের কাছে জনপ্রিয়তা পান যখন ২০২৩ সালে রাশিয়া-আফ্রিকা সামিটে তিনি বক্তব্য দেন।

সেসময় তিনি আফ্রিকান নেতাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন যে ‘প্রতিবার সাম্রাজ্যবাদী নেতাদের ঘোরানো ছড়ির ইশারায় পুতুলের মত নাচা বন্ধ করুন।’

তার ঐ বক্তব্য সেসময় রাশিয়ার গণমাধ্যমে ফলাওভাবে প্রচার করা হয়েছিল। ট্রায়োরেকে পুরো আফ্রিকার নেতা হিসেবে তুলে ধরতে ঐ প্রচারণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

কিছুদিন আগে নাৎসি জার্মানির বিরুদ্ধে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ার বিজয় উদযাপনের ৮০ বছর পূর্তি উপলক্ষে রাশিয়া গিয়েছিলেন ট্রায়োরে।

সেখানে বৈঠক শেষে তিনি সামাজিক মাধ্যম এক্সে পোস্ট করেন যে তিনি সহ পার্শ্ববর্তী দেশ মালি ও নাইজারের সেনাশাসকরা মিলে ‘সন্ত্রাসবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হতে বদ্ধপরিকর।’

তার সোশ্যাল মিডিয়া ক্যাম্পেইন ও বাকপটুতা তাকে সারাবিশ্বেই বেশ জনপ্রিয় করে তুলেছে। আফ্রিকান-আমেরিকান ও কৃষ্ণাঙ্গ ব্রিটিশ নাগরিকদের মধ্যেও তার এই জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়েছে বলে বলছিলেন গবেষক মিজ ওচিয়েং।

“বর্ণবাদ, সাম্রাজ্যবাদ বা দাসত্বের প্রভাব যারা অভিজ্ঞতা করেছেন, তারা সবাই তার বার্তার অর্থ অনুভব করতে পারবেন”, বলছিলেন মিজ ওচিয়েং।

ট্রায়োরের অধীনে রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করায় বুরকিনা ফাসোর অর্থনীতিও শক্তিশালী হয়েছে।

ছবির উৎস, Getty Images

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ অবশ্য ট্রায়োরের খুব একটা ভক্ত নন।

ফরাসি প্রেসিডেন্ট ট্রায়োরেকে ‘স্বঘোষিত আফ্রিকা পন্থী ও নব্য-সাম্রাজ্যবাদী’ জোটের অংশ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন তার এক বক্তব্যে।

২০২৩ সালে ঐ বক্তব্যে তিনি চীন ও রাশিয়াকে অভিযুক্ত করেছিলেন আফ্রিকার সাবেক ফরাসী কলোনি থাকা দেশগুলোকে অস্থিতিশীল করার অভিযোগে।

ট্রায়োরে যদিও ক্ষমতায় এসে সন্ত্রাসবাদ দমনের প্রতিশ্রুতি রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন। বুরকিনা ফাসোতে গত ১০ বছর ধরে চলা ইসলামি বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যক্রম এখন পার্শ্ববর্তী শান্তিপূর্ণ দেশ বেনিনেও ছড়িয়ে পড়েছে।

ইব্রাহিম ট্রায়োরের জান্তা সরকার সরকারের সমালোচনাকারী বিরোধীদের বিরুদ্ধেও শক্ত অবস্থান নিয়েছে।

বিরোধী দল, মিডিয়া, জান্তা সরকারের সমালোচনাকারী চিকিৎসক, প্রশাসক সবাইকে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে চলা যুদ্ধের ফ্রন্টলাইনে পাঠিয়ে শাস্তি দিয়ে থাকে জান্তা সরকার।

তবে এসব সমালোচনা ইব্রাহিম ট্রায়োরের জনপ্রিয়তায় ভাটা ফেলতে পারেনি।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের আফ্রিকা অঞ্চলের ডেপুটি ডিরেক্টর রিনাল্ডো ডেপানিয়ের মতে ট্রায়োরে এতো জনপ্রিয়, কারণ তিনি ‘তরুণদের দেশের তরুণ নেতা।’ বুরকিনা ফাসোর জনসংখ্যার বর্তমান গড় বয়স ১৭.৭ বছর।

“এছাড়া তিনি মিডিয়াকে বোঝেন, এবং তিনি অতীতের উদাহরণ ব্যবহার করে নিজেকে থমাস সাঙ্কারার উত্তরসূরি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছেন”, বলছিলেন তিনি।

“আর তিনি রাজনীতির খেলাটা বোঝেন – যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি দেশের আতঙ্কিত মানুষকে সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখিয়েছেন তিনি। এই খেলায় তিনি বেশ সুকৌশলী খেলোয়াড়।”

১৯৮৭ সালে নিহত হওয়া 'আফ্রিকার চে গেভারা' নামে পরিচিত বুরকিনা ফাসোর মার্ক্সিস্ট বিপ্লবী নেতা থমাস সাঙ্কারা আফ্রিকার অনেক দেশে তরুণদের কাছে বিপ্লবের প্রতীক

ছবির উৎস, AFP

আফ্রিকার চে গেভারা হিসেবে খ্যাত থমাস সাঙ্কারা ১৯৮৩ সালে ৩৩ বছর বয়সে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিলেন। সেসময় তিনি ‘পিতৃভূমি অথবা মৃত্যু’ স্লোগান দিয়ে সারাদেশে র‍্যালি করেছিলেন।

চার বছর পর আরেকটি অভ্যুত্থানে তিনি নিহত হন এবং আবারো বুরকিনা ফাসো ফ্রান্সের রাজনৈতিক বলয়ের অধীনে ফিরে যায়। ২০২২ সালে ইব্রাহিম ট্রায়োরে ক্ষমতা দখল করার আগ পর্যন্ত ঐ বলয়ের অধীনেই ছিল বুরাকিনা ফাসো।

অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, ইব্রাহিম ট্রায়োরের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি আফ্রিকা মহাদেশের রাজনীতির পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করে।

ঘানার নিরাপত্তা বিশ্লেষক কুয়েসি আনিংয়ের মতে, আফ্রিকার অনেক দেশের নেতাদের সাথে ইব্রাহিম ট্রায়োরের চিন্তাধারার পার্থক্য তার জনপ্রিয়তার আরো একটি অন্যতম কারণ। আফ্রিকার অনেক দেশের বর্ষীয়ান শীর্ষ নেতাই বহু বছর ধরে নির্বাচন কারচুপি করে ক্ষমতা আঁকড়ে রয়েছেন।

“ট্রায়োরে স্টাইলিশ ও আত্মবিশ্বাসী, তার হাসি স্মিত আর তিনি বাকপটু। তিনি অত্যন্ত ভালো বক্তাও, এবং নিজেকে তিনি জনগণের কাছের মানুষ হিসেবে তুলে ধরতে ভালোবাসেন।”

ট্রায়োরের অধীনে রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করায় বুরকিনা ফাসোর অর্থনীতিও শক্তিশালী হয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের হিসেবে বুরকিনা ফাসোতে মূল্যস্ফীতি বাড়লেও ২০২৩ এর তুলনায় ২০২৪ এ চরম দারিদ্র্য প্রায় দুই শতাংশ কমেছে।

এছাড়া জান্তা সরকার ঘরোয়া রাজস্ব আদায়, শিক্ষায় ব্যয়বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা খাতে উন্নয়নের ক্ষেত্রে ‘উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি’ করেছে বলে এপ্রিলে এক বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল।

ইব্রাহিম ট্রায়োরের জান্তা সরকারের অধীনে কৃষি, শিক্ষাখাতে উন্নতি করেছে বুরকিনা ফাসো।

ছবির উৎস, Ibrahim Traoré/X

তবে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের এসব ইতিবাচক রিপোর্ট সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র আর ফ্রান্সের সাথে বুরকিনা ফাসোর সম্পর্ক খুব একটা ভালো নেই। ইউএস-আফ্রিকা কমান্ডের জেনারেল মাইকেল ল্যাংলি সম্প্রতি তার এক বক্তব্যে মন্তব্য করেন যে ট্রায়োরে তার দেশের স্বর্ণের মজুদ দেশের উন্নয়নের চেয়ে জান্তা সরকারের উন্নয়নে ব্যবহার করছেন।

জেনারেল ল্যাংলির এই মন্তব্য ট্রায়োরের সমর্থকদের মধ্যে বড় ধরনের ক্ষোভ তৈরি করেছিল।

জান্তা সরকার কিছুদিন পরেই জানায় যে তারা একটি অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা নস্যাৎ করেছে, যেটি পার্শ্ববর্তী দেশ আইভরি কোস্ট থেকে পরিকল্পনা করা হয়েছিল। জেনারেল ল্যাংলি সেসময় আইভরি কোস্ট পরিদর্শন করছিলেন।

এর কিছুদিন পরেই জান্তা সরকার বুরকিনা ফাসোর রাজধানীতে বিশাল এক র‍্যালি আয়োজন করে। ইব্রাহিম ট্রায়োরে এই র‍্যালির পর তার সোশ্যাল মিডিয়ায় ফরাসী ও ইংরেজিতে পোস্ট করে তার সমর্থকদের ধন্যবাদ জানায় ও ‘নতুন বুরকিনা ফাসো ও আফ্রিকা’ প্রতিষ্ঠায় তার পাশে থাকার অনুরোধ করেন।

তরুণ এই ক্যাপ্টেনের শেষ কেমন হবে, তা জানা অসম্ভব হলেও তার সাথে মালি ও নাইজারের নেতারা নিশ্চিতভাবে পশ্চিম আফ্রিকার বাস্তবতা বদলে দিয়েছেন। আফ্রিকার আরো কয়েকটি দেশও তাদের উদাহরণ অনুসরণ করে ফ্রান্সের সেনাদের দেশ ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছে।

গবেষক মি. আইকিন্সের মতে, আফ্রিকার অনেক দেশের সেনাশাসক ও একনায়কদের মত ক্ষমতাকে ‘ব্যক্তিকেন্দ্রিক’ না করে ও বিরোধীদের দমনের নীতি না নিয়ে শান্তি, নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি সুশাসন প্রতিষ্ঠার দিকে নজর দিলে ইব্রাহিম ট্রায়োরে হয়তো আফ্রিকার সর্বকালের সেরা নেতাদের একজন হিসেবে বিবেচিত হতে পারেন।