Source : BBC NEWS

ছবির উৎস, Getty Images
ভারতে লখনৌ বা অওয়ধি, হায়দ্রাবাদি, রামপুরী-সহ বিরিয়ানির যতগুলো নামকরা বনেদি ঘরানা আছে, তার কোনওটাতেই আলু ব্যবহার হয় না – কিন্তু এর একমাত্র ব্যতিক্রম কলকাতার বিরিয়ানি।
বস্তুত ওই শহরের বিরিয়ানিতে আলু শুধু একটা সিগনেচার উপাদানই নয়, মাংস-চাল-জাফরানের অ্যারোমাতে মাখামাখি দু-এক টুকরো হলুদ ডুমো ডুমো আলু না থাকলে সেটাকে কলকাতা বিরিয়ানি বলে ধরাই হয় না!
দেশের অন্য কোথাও এর চল না থাকলেও কলকাতার বিরিয়ানিতে কীভাবে আলু অপরিহার্য হয়ে উঠলো, তা নিয়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় লোকগাথাটি এরকম :
উনিশ শতকের মাঝামাঝি ব্রিটিশের কাছে রাজ্যপাট খুইয়ে অওধের শেষ নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ যখন কলকাতায় চলে আসতে বাধ্য হলেন – তখন তার দিন চলত সরকারের দেওয়া পেনশনেই।
রাজত্ব গেলেও রাজসিক ঠাঁটবাটের অভাব ছিল না নবাবের, শহরের পশ্চিমপ্রান্তে মেটিয়াবুরুজে মিনি-লখনৌ তৈরি করে সেখানে খানাপিনা, বিলাসব্যাসন চলছিল অবাধেই।
কিন্তু নবাবের সংসার চলে পেনশনের গোনাগুনতি টাকায়, তাই বিরিয়ানির জন্য কেনাকাটা করতে গিয়ে ওয়াজেদ আলি শাহ-র বাজার সরকাররা মাংস কিনে না কি খরচে কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না!
নবাবকে এই সমস্যার কথা বলতেই তিনি সমাধান বাতলালেন, বেশ তো – মাংস কমিয়ে দিয়ে তাহলে আলুও দিয়ে দাও, খরচ কম পড়বে!
যে কথা সেই কাজ, আর আলু-ওলা বিরিয়ানি স্বাদেও দেখা গেল সাঙ্ঘাতিক, নবাবেরও খুব পছন্দ হলো – আর তখন থেকেই না কি সেই বিরিয়ানি হয়ে উঠলো আলুর পাকাপাকি ঠিকানা!

ছবির উৎস, Getty Images
কিন্তু দেশের বেশির ভাগ ফুড হিস্টোরিয়ান এই কাহিনি সত্যি বলে মানেন না, ওয়াজেদ আলি শাহ-র বংশধররাও জোর দিয়ে দাবি করেন এই গল্পটা একশো ভাগ গাঁজাখুরি!
প্রশ্ন হলো, তাহলে আসল ঘটনাটা কী? বিরিয়ানিতে আলু এলো কীভাবে?
বিবিসি বাংলা এর জবাব খুঁজতে গিয়ে মোটামুটি তিনটে থিওরি বা তত্ত্ব পেয়েছে – যার প্রত্যেকটার সমর্থনেই কিছু কিছু ঐতিহাসিক তথ্য ও প্রমাণ আছে।
প্রথম থিওরিটা হল, নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ-র কখনওই এমন দুরবস্থা হয়নি যে তার ঢালাও পরিমাণে মাংস কেনার ক্ষমতা ছিল না। হ্যাঁ, তিনি বিরিয়ানিতে আলু যোগ করেছিলেন ঠিকই – কিন্তু সেটা একদম নতুন একটা ‘এক্সোটিক রুট ভেজিটেবল’ পরখ করার জন্য, মানে ওটা ছিল একটা এক্সপেরিমেন্ট।
দ্বিতীয় তত্ত্বটা আবার বলে, বিরিয়ানিতে আলু দেওয়ার সঙ্গে নবাবের সরাসরি কোনও সম্পর্ক নেই – এর মূলে আছে পেটরোগা বাঙালি বাবুদের তেল-ঘি-মশলা হজম না হওয়া!
কোনও কোনও গবেষক জানাচ্ছেন, সেই আমলে যখন কলকাতার বাবুরা নবাবের সঙ্গে আসা বাঈজিদের আসরে যাওয়া এবং মোগলাই খানা খাওয়া শুরু করলেন – তখন তাদের দু্র্বল পেটের জন্য রান্নাকে কিছুটা ‘লাইট’ করতেই না কি বিরিয়ানিতে আলুর প্রচলন শুরু।কারণ তেল-মশলা অ্যাবসর্ব করতে আলুর কোনও জুড়ি নেই!

ছবির উৎস, Getty Images
তিন নম্বর আর একটা তত্ত্ব আবার বলছে, কলকাতা শহরে বিরিয়ানিতে আলু দেওয়ার শুরু দেশভাগ আর স্বাধীনতার পরে – ১৯৫০ বা ৬০-র দশকে, বাঙালি মধ্যবিত্তর যখন পকেটে বেশ টানাটানি চলছে!
এই মতবাদের প্রবক্তারা বলেন ওয়াজেদ আলি শাহ হয়তো কলকাতার সঙ্গে বিরিয়ানির প্রথম আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন – কিন্তু তাতে আলুর ব্যাপক অনুপ্রবেশ হয়েছে তারও প্রায় একশো বছর পরে!
এই প্রতিটা মতবাদ বা তত্ত্বর পেছনে কী কী তথ্য, যুক্তি আর কাহিনি আছে – সেটাই দেখেছে এই প্রতিবেদন।
যার হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া …
মনজিলাত ফতিমা সম্পর্কে নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ-র প্রপৌত্রী – আর কলকাতায় ইস্টার্ন বাইপাসের কাছে তার রুফটপ রেস্তোরাঁ শহরে অথেনটিক বিরিয়ানির একটি সেরা ঠিকানা বলে গণ্য।
নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ আর তার বেগম হজরত মহলের ছেলে, বিরজিস কাদেরের নাতি হলেন ড: কাওকুব কাদের মির্জা – যিনি মনজিলাতের বাবা। ভদ্রমহিলা শুধু নবাবি খানদানের অংশই নন, অওধের নবাবদের খানাপিনাও তিনি কলকাতাবাসীকে আজও পাত পেড়ে খাওয়াচ্ছেন।
এবং নবাব মাংস ‘অ্যাফোর্ড’ করতে পারতেন না বলে বিরিয়ানিতে আলু এসেছিল – এই দাবিটাও মনজিলাতের মতে ‘একশো ভাগ রাবিশ’!

ছবির উৎস, Getty Images
“দেখুন, অওয়ধি ক্যুইজিনের বিশেষত্বই হল এটা চিরকাল নানা ধরনের পরীক্ষানিরীক্ষা করতে ভালবাসে।”
“ওয়াজেদ আলি শাহ যখন কলকাতায় এলেন আর দেখলেন এখানকার বাজারে আলু বলে নতুন একটা সব্জি এসেছে, তার বাবুর্চিরা মাংসের সঙ্গে সেটা দিয়েই বিরিয়ানি রাঁধলেন আর সেটা সবার ভাল লেগে গেল – ব্যাপারটা জাস্ট এরকমই”, বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মনজিলাত ফতিমা।
তবে ঘটনাটা যে নবাবের নিজস্ব হেঁশেলেই ঘটেছে, তা না-ও হতে পারে।
“আসলে নবাবের নিজের যেমন আলাদা রান্নাঘর ছিল, তার মায়ের, বেগমদের বা বোনেরও কিন্তু প্রত্যেকের আলাদা রান্নাঘর ছিল। এর কোনও একটা দিয়েই বিরিয়ানিতে আলুর প্রবেশ, এমনটাই আমরা জেনে এসেছি”, বলছিলেন এই রন্ধনশিল্পী।
আর আলু যে তখন বেশ মহার্ঘ একটা সব্জি ছিল এবং মাংসের চেয়ে সেটার দাম বেশি ছাড়া কম ছিল না – সেটাও মনে করিয়ে দিচ্ছেন তিনি।
“দ্বিতীয়ত, ওয়াজেদ আলি শাহ তখন রীতিমতো মোটা পেনশন পেতেন – বছরে বারো লক্ষ রুপির বেশি, যার ফলে তাকে শখ-আহ্লাদ-বিলাসিতায় মোটেই কোনও কাটছাঁট করতে হয়নি।”
“১৮৬৪ সালে তিনি কলকাতার মেটিয়াবুরুজে একটা আস্ত চিড়িয়াখানাই খুলে ফেলেন, যেখানে দেশ-বিদেশ থেকে বাঘ, সিংহ, লেপার্ড সবই আনা হয়েছিল”, জানাচ্ছেন মনজিলাত ফতিমা।

ছবির উৎস, Getty Images
যে চিড়িয়াখানাতে বাঘ-সিংহের খাবার জন্য রোজ কিলো কিলো মাংস কেনা হত, তার মালিক নিজে বিরিয়ানির জন্য মাংস কিনতে পারবেন না – এই যুক্তি মোটেই বিশ্বাস্য নয় বলে মনে করেন তিনি।
লেখক-গবেষক রোজি লেওয়েলিন-জোনস তার ‘লাস্ট কিং অব ইন্ডিয়া’ (২০১৪) বইতেও লিখেছেন, ওয়াজেদ আলি শাহ সেই আমলে তার চিড়িয়াখানার পশুদের জন্যই মাসে কম করে ৯০০০ রুপি খরচ করতেন – যেটা ছিল বি-শা-ল একটা অঙ্ক!
তো যিনি বাঘ-সিংহের জন্য এত টাকা ওড়াতে পারেন তাকে আর যাই হোক গরিব বা কিপটে কিছুতেই বলা যায় না!
ওয়াজেদ আলি শাহ্-র চতুর্থ প্রজন্মের আর এক বংশধর, শাহানশাহ মির্জা আবার বছরপাঁচেক আগে দ্য হিন্দুস্থান টাইমস পত্রিকাকে বলেছিলেন – গরিবিয়ানার জন্য নবাব বিরিয়ানিতে আলু দিতে বাধ্য হয়েছিলেন, এটা নাকি ছিল ব্রিটিশ ইতিহাসবিদদের অপপ্রচার।
“সেই আমলের লখনৌর সমৃদ্ধি লন্ডন-প্যারিসকেও টেক্কা দিত – যাতে সাহেবদেরও চোখ টাটাত।”
“তো নবাবের সেই রাজ্য কেড়ে নিয়েও তাদের শান্তি হয়নি, আলু নিয়ে মিথ্যা বদনাম করে তারা ওয়াজেদ আলি শাহ্-কে সব সময় হেয় করে দেখাতে চেয়েছে”, বলেছিলেন শাহানশাহ মির্জা।

ছবির উৎস, Getty Images
আর একটা মজার বিষয় হল, অওয়ধি ঘরানার বিরিয়ানি কলকাতায় এসে আলুকে আপন করে নিয়ে নতুন চেহারা নিলেও লখনৌতে মূল অওয়ধি ধারার বিরিয়ানিতে কিন্তু আজও আলুর প্রবেশ নিষিদ্ধ!
“আপনি লখনৌতে গেলে আজও কিন্তু বিরিয়ানিতে আলু পাবেন না! পাকিস্তানেও কোথাও বিরিয়ানিতে আলুর চল নেই, ভারতেও একমাত্র কলকাতা ছাড়া সেভাবে কোথাও নেই!”
“ব্যতিক্রম অবশ্যই ঢাকা – যা এক সময় অবিভক্ত বাংলারই অংশ ছিল। তবে সেখানেও বিরিয়ানিতে আলু দেওয়ার এই অভ্যেসটা অবধারিতভাবে কলকাতা থেকেই ট্র্যাভেল করেছে”, বলছিলেন মনজিলাত ফতিমা।
পেটরোগা বাঙালি বাবুদের জন্যই আলু?
ভারত সরকারের সর্বোচ্চ আমলাদের একজন ছিলেন জহর সরকার – দেশের প্রাক্তন সংস্কৃতি সচিব, সাবেক পার্লামেন্টারিয়ানও বটে। নিজের শখ আর আগ্রহে বাঙালির বিভিন্ন খাবারের ইতিহাস নিয়ে চর্চা আর গবেষণাও করছেন দীর্ঘদিন ধরে।
বাংলার বিরিয়ানিতে কীভাবে আলু এলো, তা নিয়ে তিনি আবার একটু ভিন্ন ধাঁচের বিবরণে বিশ্বাস করেন।
বিবিসি বাংলাকে তিনি এ প্রসঙ্গে যা বললেন, সেটা শোনা যাক মি সরকারের বয়ানেই –
“দেখুন, আমরা সবাই জানি ভারতে আলু এনেছিল পর্তুগিজরা, সপ্তদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে। পশ্চিম ভারতের সুরাটে প্রথম আলু চাষ শুরু হয়, সেখান থেকে যায় গোয়ার দিকে – আর ওখানে কিন্তু আজও আলুকে তার মূল পর্তুগিজ নাম ‘বাটাটা’ বলেই ডাকা হয়।

ছবির উৎস, Getty Images
বাংলায় আলু চাষ শুরু হতে অবশ্য তখনও অনেক দেরি। ১৭৯৩ সালে ব্রিটিশ পাদ্রী উইলিয়াম কেরি যখন ডেনিশ পাসপোর্ট নিয়ে ডেনমার্কের কলোনি শ্রীরামপুরে থাকতে শুরু করলেন, তিনি ওই এলাকার চাষীদের মধ্যে আলুর বীজ বিলি করে আলু চাষে উতসাহ দিয়েছিলেন বলে জানা যায়।
পরে ১৮২০ সালে তিনিই কলকাতার আলিপুরে এগ্রি হর্টিকালচারাল সোসাইটি স্থাপন করলেন – যেখানে মূলত ইউরোপীয়ানদের জন্য এমন কিছু শাকসবজির চাষ শুরু হলো, যেগুলো তারা ভারতে পেতেন না। যেমন, পিজ বা মটর, এবং আলু। কলকাতার বুকে আলু চাষের সেই শুরু, যদিও বাংলার সাধারণ মানুষের পাতে তখনও আলু আসেনি।
ওই একই সময় ব্রিটিশরা চীনে ব্যবসা করে মোটা মুনাফা লোটার আশায় বাংলায় ব্যাপকভাবে আফিম চাষ শুরু করল, যে কারণে ইতিহাসবিদ উইলিয়াম ড্যালরিম্পল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ইতিহাসের প্রথম ‘ড্রাগ ওয়ারলর্ড’ বা মাদক মাফিয়া বলে বর্ণনা করেছেন!
আর বাংলায় এই আফিম চাষের সূত্র ধরেই আলু নিয়ে একটা মজার ঘটনা ঘটল।
আফিমের খোসা – যেটাকে এখন আমরা পোস্ত নামে চিনি – সেটা আগে ফেলে দেওয়া হত। কিন্তু বাঁকুড়া-বীরভূমের আফিম চাষীরা লক্ষ্য করল, ওই খোসাটা যদি আলুর সঙ্গে রান্না করা যায় তাহলে দারুণ খেতে লাগে।
ব্যাস, এভাবেই আলু-পোস্তর হাত ধরেই বাংলার হেঁশেলে আলু ঢুকতে শুরু করলো, তবে তখনও সেটা সীমিত ছিল নিম্নবিত্ত চাষাভুষোদের ঘরেই।

ছবির উৎস, Getty Images
কলকাতার সম্পন্ন পয়সাওলা বাবুদের খাবার পাতে আলু এলো আরও অনেক পরে – আর তাতেও ওয়াজেদ আলি শাহর একটা পরোক্ষ অবদান আছে।
আসলে অওধের নবাব যখন তার লোকলস্কর আর পাইক-বরকন্দাজ নিয়ে লখনৌ থেকে কলকাতায় এলেন, তার সঙ্গে প্রিয় বাঈজিদেরও এনেছিলেন – আর এদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলেন দু’জন, নিম্মিবাঈ আর মুন্নিবাঈ।
এই ডাকসাইটে সুন্দরী আর লাস্যময়ী নর্তকীদের নিয়ে জলসা বসাতে কলকাতার পয়সাওলা বাবুদের মধ্যে গঙ্গার ধারে বাগানবাড়ি বানানোর হিড়িক পড়ে গেল – আর বেশি মাইনের লোভে নবাবের অনেক খানসামা, বাবুর্চি, আর্দালিও সেখানে গিয়ে জুটলো।
এই পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল – কিন্তু গোল বাঁধলো যখন অতিরিক্ত তেল-ঘি-ওলা মশলাদার নবাবি খানা বাঙালি বাবুদের পেটে সহ্য হলো না!
ঠিক এই সমস্যার সমাধান বের করতেই রান্নাঘরে আলুর আমদানি – কারণ দেখা গেল বাজারে সদ্য আসা এই নতুন সব্জিটা তেল-মশলা অনেকটা টেনে নিয়ে পদগুলোকে যেমন বেশ সহজপাচ্য করে তোলে, সেই সঙ্গে নিজেও সেই রঙে-রসে জারিত হয়ে ওঠে অসম্ভব সুস্বাদু!
ফলে কলকাতার বিরিয়ানিতে আলুর এই ‘এলাম-দেখলাম-জয় করলাম’ সাফল্যের পেছনে আমি কৃতিত্ব দেব বাঙালির দু্র্বল হজম ক্ষমতাকেই!”, এক টানে বলে যান জহর সরকার।

ছবির উৎস, Getty Images
দিল্লির জেএনইউ-এর সাবেক অধ্যাপক ও ভারতের সুপরিচিত ফুড হিস্টোরিয়ান পুষ্পেশ পন্থও এই ধারণার সঙ্গে মোটামুটি অনেকটাই সহমত।
“ওয়াজেদ আলি শাহ-র পয়সার টানাটানি ছিল বলে বিরিয়ানিতে মাংসের সঙ্গে আলু মেশাতেন, এর চেয়ে বাজে কথা আর কিছুই হতে পারে না!”
“বিরিয়ানিতে আলু আর ডিম মেশালে রান্নাটা অনেকটা ‘লাইট’ বা হালকা হয়, মশলাটা টেনে যায় – জেনে রাখুন এটাই আসল কারণ”, বিবিসিকে বলছিলেন অধ্যাপক পন্থ।
বিরিয়ানিতে আলু এসেছে স্বাধীনতার পরে?
কলকাতার স্থাপত্য, সংস্কৃতি ও খানাপিনার ইতিহাস নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা, লেখালেখি ও ভ্লগিং করছেন দীপাঞ্জন ঘোষ, ‘হাফ প্যান্ট হিস্ট্রি’ নামে একটি জনপ্রিয় পেজেরও কর্ণধার তিনি।
দীপাঞ্জন বিশ্বাস করেন কলকাতার বিরিয়ানিকে আমরা আজ যে চেহারায় চিনি, সেটা মূলত আসতে শুরু করেছে ষাটের দশক থেকে – মানে ভারতের স্বাধীনতা লাভেরও দশ-পনেরো বছর পর। শহরের বিরিয়ানিতে আলু জনপ্রিয় হতে শুরু করে তখন থেকেই।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলছিলেন, “নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ মারা যাচ্ছেন ১৮৮৭ সালে, আর কলকাতার ঘরে ঘরে বিরিয়ানির বিপুল জনপ্রিয়তা শুরু হচ্ছে ষাটের দশকে।”
“এই দুটোর মাঝে কিন্তু একটা লম্বা সময়ের ব্যবধান – আর সে কারণেই ওয়াজেদ আলি শাহ কলকাতার বিরিয়ানিতে আলুর প্রবর্তক হিসেবে কতটা কৃতিত্বের দাবিদার তা নিয়ে সন্দেহ আছে!”

ছবির উৎস, Half Pant History
তিনি আরও মনে করিয়ে দিচ্ছেন, একটা সময় কলকাতার বিরিয়ানি মানেই বোঝাতো যে চিতপুরের আইকনিক দোকান ‘রয়্যালে’র বিরিয়ানি – তারা কিন্তু তাদের সেই আইটেমে কখনওই আলু দিত না। তবে রয়্যাল অবশ্য নিজেদের হায়দ্রাবাদি ঘরানার বলেই দাবি করে থাকে, অওয়ধি ঘরানার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নেই!
ইদানীং অবশ্য প্রতিযোগিতার ‘চাপে পড়ে’ রয়্যালও তাদের পার্ক সার্কাস শাখায় বিরিয়ানিতে আলু যোগ করার অপশন রেখেছে।
দীপাঞ্জন ঘোষ আরও বলছিলেন, আজকের যেটা পশ্চিমবঙ্গ, সেখানে আলু চাষের প্রথম নথিভুক্ত রেকর্ড পাওয়া যায় ১৮৭৯ সালে – যখন দার্জিলিংয়ের ব্রিটিশ বাসিন্দারা সেখানে একটা বোটানিক্যাল গার্ডেন স্থাপনের জন্য ইংল্যান্ড থেকে আলুর বীজ আনিয়েছিলেন।
“ওয়াজেদ আলি শাহ মারা যাচ্ছেন এর আট বছরের মধ্যেই – ফলে এত কম সময়ের মধ্যে আলু তার রান্নাঘরে ঢুকে বিরিয়ানি জয় করে ফেললো, এই সম্ভাবনা বেশ কম বলেই মনে হয়”, জানাচ্ছেন তিনি।
কলকাতার সুপরিচিত ফুড হিস্টোরিয়ান পূর্ণা ব্যানার্জিও লিখেছেন, ওয়াজেদ আলি শাহ-ই হয়তো কলকাতাকে প্রথম বিরিয়ানি খাইয়েছেন – কিন্তু তার মানে এই নয় যে তিনিই বিরিয়ানিতে আলু যোগ করেছিলেন।

ছবির উৎস, Kolkata Archives
মিস ব্যানার্জির কথায়, “বিরিয়ানিতে আলু যোগ করার চল শুরু হল ১৯৫০র দশকের পর থেকে – যখন বিরিয়ানি সম্ভ্রান্ত ও অভিজাত শ্রেণির খাবার থেকে সাধারণ মানুষের কাছেও পৌঁছতে শুরু করলো।”
“কিন্তু এত মাংস-বোঝাই একটা রান্না তারা খরচে পুষিয়ে উঠতে পারছিলেন না, তাই তাতে আলু যোগ করে খরচে রাশ টানার একটা চেষ্টা করা হলো।”
তাহলে সত্যি কোনটা?
উপরে যে তিনটে থিওরি নিয়ে আলোচনা হল, সত্যি কথা বলতে কী বিরিয়ানিতে আলুর আবির্ভাব নিয়ে এর যে কোনওটাই সত্যি হতে পারে – আবার এগুলোর মাঝামাঝি কিছুও বাস্তবে ঘটে থাকতে পারে।
জিনিসটা ঠিক কীভাবে ঘটেছে, তার খুব অকাট্য ও নির্দিষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ নেই – ফলে গবেষকদের এক্ষেত্রে নির্ভর করতে হচ্ছে মূলত জনশ্রুতি, পারিপার্শ্বিক তথ্যপ্রমাণ বা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মতো ‘অ্যানেকডোটাল এভিডেন্সে’র ওপরেই।
তবে যারাই বিষয়টা নিয়ে চর্চা করেছেন, তারা সবাই প্রায় একবাক্যে বলছেন ওয়াজেদ আলি শাহ আর্থিক দুর্দশায় পড়েছিলেন বলেই বিরিয়ানিতে মাংসের জায়গায় আলু দিয়েছিলেন – এর চেয়ে বাজে কথা আর হতে পারে না!

ছবির উৎস, Getty Images
এই অস্পষ্টতা আর ধোঁয়াশার মধ্যেও যে বিষয়টা নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই – তা হলো যেভাবেই এসে থাকুক না কেন, আজকের কলকাতার কিন্তু আলু ছাড়া বিরিয়ানি মুখেই রোচে না!
আর কলকাতার বিরিয়ানি যেহেতু ‘দম-পোখত’ কায়দায়, মানে ঢিমে আঁচে আর ময়দা দিয়ে হাড়ির মুখ এয়ারটাইট করে আটকে রান্না করা হয় – তাই ভেতরের সব মশলা-মাংস-ঘির সুঘ্রাণও আলুর রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে যায়, অনেকে তো মাংস ফেলে আগে আলুতেই কামড় বসান।
বিহারের প্রবাদপ্রতিম রাজনীতিবিদ লালুপ্রসাদ যাদব যখন কেরিয়ারের তুঙ্গে, তার অনুগামীরা একটা স্লোগান খুব দিতেন – ‘যব তক রহেগা সামোসামে আলু, তব তক রহেগা বিহারমে লালু’।
মানে সামোসায় যতদিন আলু থাকবে, বিহারেও ততদিন লালুর রাজত্ব চলবে!
বিহারের রাজনৈতিক দৃশ্যপট থেকে লালুপ্রসাদ আজ বিদায় নিলেও সামোসাতে (সিঙাড়া) আলু কিন্তু ঠিকই রয়ে গেছে!
কলকাতার আপামর খাদ্যরসিকও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, শহরে যতদিন বিরিয়ানি থাকবে – সেই প্লেটে অবধারিতভাবে আলুও কিন্তু থাকতেই হবে।