Home LATEST NEWS bangla সর্বশেষ সংবাদ ছাত্রদল নেতা হত্যার ঘটনায় উত্তপ্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ছাত্রদল নেতা হত্যার ঘটনায় উত্তপ্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

3
0

Source : BBC NEWS

মঙ্গলবার রাতে ছুরিকাঘাতে নিহত হন শাহরিয়ার আলম সাম্য

ছবির উৎস, Shahriar Alam Shammo/Facebook

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মঙ্গলবার রাতে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে মারা গেছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী। তার মৃত্যুকে ঘিরে রাত থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভে নামে শিক্ষার্থীরা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার আলম সাম্য একটি হল শাখা ছাত্রদলের নেতাও ছিলেন।

নিজ সংগঠনের নেতার মৃত্যুর ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায় দেখছে ছাত্রদল। সে কারণে অবিলম্বে উপাচার্য ও প্রক্টরের পদত্যাগের দাবিতে তারা বুধবার ক্যাম্পাসে আন্দোলনও করেছে সংগঠনটি।

ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “এই ঘটনায় ভিসি ও প্রক্টর স্যারের গাফিলতি রয়েছে। এই ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির কারণে তাদের নিজ থেকে সরে যাওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি।”

তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলেছে, যে জায়গাটিতে হামলার ঘটনা ঘটেছে সেটি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার বাইরে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

এই ঘটনার পর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের নিরাপত্তা বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ।

এই হত্যাকাণ্ডের পর নিহতের বড় ভাই রাজধানীর শাহবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন।

এদিকে, হত্যায় জড়িত সন্দেহে তিনজনকে আটকের কথা জানিয়েছে পুলিশ। তাদের প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদও চলছে। আটকদের কেউই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী না বলেও পুলিশ জানিয়েছে।

এ নিয়ে আরো পড়তে পারেন
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এলাকাই মঙ্গলবার রাতে এই হত্যার ঘটনাটি ঘটে

ছবির উৎস, Getty Images

কী হয়েছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে?

শাহরিয়ার আলম সাম্য ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী এবং এফ রহমান হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন। তার বাড়ি সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলায়।

সাম্যর সহপাঠীরা জানান, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এফ রহমান হল ছাত্রদলের সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক ছিলেন।

কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায় এই হামলার ঘটনাটি ঘটলো জানতে বিবিসি বাংলা ঘটনাস্থলে থাকা তার সহপাঠী, পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলেছে।

তার একাধিক সহপাঠী বিবিসি বাংলাকে জানান, রাতে মোটরসাইকেল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভেতর যাচ্ছিলেন সাম্য। এসময় অন্য একটি মোটরসাইকেলের সঙ্গে তার মোটরসাইকেলের ধাক্কা লাগলে উভয়ের মধ্যে কথা কাটাকাটি ও ধস্তাধস্তি হয়।

সাম্যর সহপাঠী শাহেদ হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমাদের একটা নবীনবরণ অনুষ্ঠান ছিল। তখন আমরা এক সাথেই ছিলাম। ওখান থেকে সাম্যসহ আমাদের তিনজন বন্ধু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যায়।”

“সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মন্দিরের গেটের ভেতরে একটা বসার মতো জায়গা আছে। ওই জায়গায় তিন-চারজন বহিরাগতের সাথে ওদের (সাম্য ও তার বন্ধুদের) তর্কাতর্কির ঘটনা ঘটে। এক পর্যায়ে তাদের সাথে ওর হাতাহাতিও হয়।”

তিনি জানান, সাম্যরা ছিলেন তিনজন। যখন বহিরাগতদের একটা অংশের সাথে ধাক্কাধাক্কি হয় তখন তাদেরই আরেকটা গ্রুপও সেখানে এসে সাম্যদের সঙ্গে হাতাহাতিতে জড়ায়।

সাম্যর বন্ধু শাহেদ বলেন, “আসলে ওরা (সাম্যরা) বোঝে নাই ওরা (যাদের সঙ্গে বিরোধ হয়) এতজন ছিল ওখানে। ওরা যখন দেখল আমাদের বন্ধুরা সবাই ক্যাম্পাসের, আমাদের সাথে গ্যাঞ্জাম করে পারবে না, তখন ওরা বাইকে স্টার্ট দিয়ে চলে যাওয়ার উদ্যোগ নিলো।”

তিনি যোগ করেন, “যাওয়ার সময় একজনের হাতে স্ট্যাব (ছুরিকাঘাত) করার মতো কিছু একটা ছিল। তখন ওটা দিয়ে স্ট্যাব করে ওরা। আঘাত করার পরই ওখান থেকে বের হয়ে যায় বহিরাগতরা। তখনই ধারালো অস্ত্রের আঘাতে সাম্য’র কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয় সম্ভবত।”

“এরপরই ওর শরীর থেকে অনেক রক্ত বের হয়ে যায়। আমরা বন্ধুরা তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পর তাকে মৃত ঘোষণা করে ডাক্তাররা,” বলছিলেন শাহেদ।

মামলার এজাহারে যা আছে

ঘটনার পরদিন বুধবার সকালে নিহত সাম্যের বড় ভাই শরীফুল ইসলাম শাহবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় অজ্ঞাতনামা ১০ থেকে ১২ জনকে আসামি করা হয়েছে।

মামলার এজাহারে বলা হয়, মঙ্গলবার দিবাগত রাত পৌনে ১১টার দিকে সাম্য তার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু আশরাফুল আলম রাফি ও আব্দুল্লাহ আল বায়েজিদকে নিয়ে মোটরসাইকেলে করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিরছিলেন।

তখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভেতরে থাকা রমনা কালি মন্দিরের উত্তর পাশের বটগাছের নিচে ১২জন তাদের মোটরসাইকেল দিয়ে সাম্যর মোটরসাইকেলে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়।

এসময় সাম্য এর কারণ জানতে চাইলে ওই ১০/১২জন পূর্বপরিকল্পিতভাবে সাম্য ও তার বন্ধুদের ইট দিয়ে আঘাত করে ও কিল-ঘুষি মারতে থাকে।

এসময় তাদের মধ্যে থেকে একজন সাম্যকে হত্যার উদ্দেশ্যে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে, একই সময় সাম্যর বন্ধুর হাতের কব্জিতেও কোপ দেয়া হয় বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়।

সাম্য রক্তাক্ত ও জখম অবস্থায় মাটিতে পড়ে গেলে দুষ্কৃতকারীরা তাকে ও তার বন্ধুদের বিভিন্ন ধরনের ভয়ভীতি ও হুমকি দিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে।

পরবর্তীতে ভিকটিমকে তার বন্ধুরা উপস্থিত লোকজনের সহায়তায় উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিসৎক তাকে মৃত ঘোষণা করেন বলে উল্লেখ করা হয় মামলার এজাহারে।

এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শাহবাগ থানার উপ-পরিদর্শক তৌফিক হাসান বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমরা ওই ঘটনা নিয়ে এরইমধ্যে কাজ শুরু করেছি। এরই মধ্যে তিনজনকে আটক করে রিমান্ড চাওয়া হয়েছে।”

শাহরিয়ার আলম সাম্য হত্যার প্রতিবাদে বুধবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেছে ছাত্রদল

তিনজন আটক, যা বলছে পুলিশ

মঙ্গলবার রাতে হত্যার ঘটনার পরপরই জড়িতদের আটকে অভিযান চালানো হয় বলে জানায় পুলিশ।

ডিএমপির মিডিয়া বিভাগের ডিসি মুহাম্মদ তালেবুর রহমান খান জানান, বুধবার সকালে শেরেবাংলা নগর থানা এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ঘটনার প্রকৃত রহস্য উদঘাটন এবং জড়িত অন্যান্যদের গ্রেফতারে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা তৌফিক হাসান বিবিসি বাংলাকে বলেন, “সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কালি মন্দিরের গেটে বহিরাগতদের সাথে কাটাকাটির এক পর্যায়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে বহিরাগত আসামিরা। আমাদের যে প্রাথমিক যে ফাইন্ডিং তাতে যতটুকু বুঝতে পেরেছি পূর্ব কোনো শত্রুতা তাদের মধ্যে ছিল না।”

ঘটনাস্থলে থাকা সাম্যর বন্ধু ও আসামিদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আটককৃত তিন জনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তা মি. হোসেন।

তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমি তাদের বন্ধুদের সাথে কথা বলেছি। আটককৃতদের সাথে কথা বলেছি। তাদের মধ্যে পূর্ব শত্রুতা ছিল না। তুচ্ছ ঘটনা থেকেই এই ঘটনার সূত্রপাত।”

এই তদন্তকারী কর্মকর্তার বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “যে তিনজনকে ধরা হয়েছে- তারা মাদক সেবনের উদ্দেশ্যে আসছিল এটা আমি শতভাগ কনফার্ম।”

আরও পড়তে পারেন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের 'অপরাজেয় বাংলা'

মুখোমুখি ছাত্রদল-বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন

ময়নাতদন্ত শেষে বুধবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে সাম্যের জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়।

এতে অংশ নেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান, ছাত্রদল সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব, সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছিরসহ বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাকর্মীরাও।

জানাজা শেষে দাফনের জন্য সাম্যের লাশ গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জে নেওয়া হয়। সেখানে দ্বিতীয় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তার দাফন সম্পন্ন হবে বলে জানিয়েছেন তার বন্ধু ও স্বজনরা।

এর আগে, মঙ্গলবার রাতে ছাত্রদল নেতা সাম্য হত্যার ঘটনাটি ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়লে রাত আড়াইটার দিকে বিক্ষোভ মিছিল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি চত্বরের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা।

সমাবেশে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থতার অভিযোগ তুলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও প্রক্টরের পদত্যাগ দাবি করে ছাত্রদল।

সেই সময়ের কিছু ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। যাতে দেখা যায়, উপাচার্যের বাড়ির সামনে বিক্ষোভ চলাকালেই বাসা থেকে বের হয়ে আসেন উপাচার্য নিয়াজ আহমেদ। সেখানে উপাচার্যের সাথে বিক্ষুব্ধ ছাত্রদল নেতাকর্মী ও শিক্ষার্থীদের কথা কাটাকাটি হয়।

পরে উপাচার্য ও প্রক্টরের পদত্যাগের দাবিতে বুধবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করে ছাত্রদল। ছাত্রদল নেতাকর্মীদের টার্গেট করে হত্যা করা হচ্ছে বলে সমাবেশে অভিযোগ করেন সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির।

এসময় ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে না পারার অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও প্রক্টরের পদত্যাগ দাবি করেছেন বিক্ষোভকারীরা।

ছাত্রদল সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব বিবিসি বাংলাকে বলেন, “সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আগে থেকেই সতর্ক করেছিল ছাত্রদল। যদি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আগে থেকেই সতর্ক থাকতো তাহলে হয়তো সাম্যকে প্রাণ দিতে হতো না।”

তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে না থাকায় নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে তারা উদ্যোগ নিতে পারেননি।

শাহরিয়ার আলম সাম্যর মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে সাত সদস্যের কমিটি গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খানকে কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে।

প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসনের অংশ হিসেবে বহিরাগতদের ক্যাম্পাস প্রবেশ নিষিদ্ধের উদ্যোগ আমরা নিয়েছিলাম যখন তখন অনেকে আমাদের এই উদ্যোগকে ভালোভাবে দেখেননি। তারপরও আমরা সেই চেষ্টা করেছি ক্যাম্পাসের নিরাপত্তার জন্য।”

তিনি জানান, এই ঘটনার পর পুলিশ, সিটি কর্পোরেশনসহ বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের সাথে পরামর্শ করে নিরাপত্তা নিশ্চিতের উদ্যোগ নেবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।