Home LATEST NEWS bangla সর্বশেষ সংবাদ গরু কোরবানি কীভাবে বাংলায় মুসলিম সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠলো

গরু কোরবানি কীভাবে বাংলায় মুসলিম সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠলো

4
0

Source : BBC NEWS

ভারতীয়  উপমহাদেশে এক গরু কোরবানির রেওয়াজ ছিল না খুব বেশি

ছবির উৎস, Kazi Salahuddin Razu/NurPhoto via Getty Images

ঈদ উল আযহা বা কোরবানির ঈদে প্রতি বছর বাংলাদেশে লাখ লাখ গরু কোরবানি হয়ে থাকে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছাগল, ভেড়া বা দুম্বার মতো পশু কোরবানি দেওয়া হলেও বাংলাদেশে গরু কোরবানি একটা যেন রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে হাজারো কোরবানির পশুর হাট বসে। সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলা এসব হাটে লাখ লাখ গরু বিক্রি হয়।

এসব হাটে গরু ছাড়াও ছাগল, ভেড়া পাওয়া গেলেও বেশিরভাগ মানুষের কাছে হাটের পরিচিতি ‘গরুর হাট’ নামেই।

বর্তমানে বাংলাদেশে গরু কোরবানি, হাট বসিয়ে বেচাকেনা ঈদুল আযহার সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়ালেও এক সময় বাংলা অঞ্চলে গরু কোরবানি দেয়া এতটা সহজসাধ্য ছিল না।

অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন তার ‘বাংলাদেশের উৎসব’ বইয়ে লিখেছেন, “আজকে আমরা যে ধুমধামের সঙ্গে ঈদ-উল আযহা পালন করি, তা চল্লিশ–পঞ্চাশ বছরের ঐতিহ্য মাত্র”।

তার বই অনুযায়ী, তখন হিন্দু জমিদার অধ্যুষিত এই ভূখণ্ডে গরু কোরবানি দেওয়া সহজ ব্যাপার ছিল না। এ জন্য অনেকে গরুর বদলে বকরি কোরবানি দিত, সেই থেকে ঈদুল আজহার আরেক নাম দাঁড়ায় বকরি ঈদ”।

ইসলামি ইতিহাসবিদরা বলছেন, এক সময় আরব বিশ্বে উট, মহিষ ও দুম্বা কোরবানি দেয়ার প্রচলন ছিল। সেখান থেকে পরে বাংলা অঞ্চলেও মহিষ ও ছাগলের সাথে গরুর কোরবানির পশু হিসেবে যুক্ত হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক মো. আতাউর রহমান মিয়াজী বিবিসি বাংলাকে বলেন, “সেই সময় এই উপমহাদেশ ও আশপাশে গরুকে সবচেয়ে বেশি হাতের কাছে পাওয়া যেতো। তখন উট ও মহিষের সাথে গরুটাও ওই সময়ে যুক্ত হয়ে গেল”।

এক সময় এই উপমহাদেশে গরু কোরবানিতে বিধি নিষেধ থাকলেও পরে সেটি কবে কীভাবে অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেলো; বাংলা অঞ্চলের সংস্কৃতিতে সে সব নিয়ে নানা ধরনের তথ্য পাওয়া যায় ইতিহাসের গল্প উপন্যাসে।

অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের মতে, বাংলা অঞ্চলে গরু কোরবানি দেয়ার রীতি শুরু হতে থাকে মূলত ১৯৪৬ সালের দিকে।

এ নিয়ে আরো পড়তে পারেন
ইসলামের বিধান অনুযায়ী গরু, মহিষ, উট, ছাগলসহ ছয় ধরনের পশু কোরবানি করা যায়

ছবির উৎস, Sazzad Hossain/SOPA Images/LightRocket via Getty Images

কোরবানির ছয়টি পশু

কোরবানি অর্থ উৎসর্গ, উপঢৌকন, সান্নিধ্য লাভের উপায়,ত্যাগ করা কিংবা পশুত্বকে বিসর্জন ইত্যাদি।

ইসলামের নবী ইবরাহিম তার ছেলে ইসমাইলকে আল্লাহর উদ্দেশ্যে কোরবানি করার উদ্যোগ নেন। সেই থেকে ইসলাম ধর্মে কোরবানি প্রথার প্রচলন হয়।

তবে ওই ঘটনাই ইসলাম ধর্মে প্রথম কোরবানির ঘটনা নয়। কারণ, ইসলামের প্রথম নবী আদমের সময়ও কোরবানির প্রথা প্রচলিত ছিলও জানা যায় বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থে।

পরবর্তীতে ইসলামের নবী মুহাম্মদের অনুসারীরাও ধর্মীয় বিধান মেনে কোরবানি করতে শুরু করেন।

ইসলামের বিধান অনুযায়ী, কোরবানি বিশুদ্ধ হওয়ার জন্য পশু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হতে হবে। ধর্মগ্রন্থ কোরআনে চতুষ্পদ জন্তুর কথাই বলা হয়েছে।

ইসলামি চিন্তাবিদদের মতে, ইসলামের নবী ইবরাহিমের সময় তার সন্তান ইসমাঈলের পরিবর্তে দুম্বা কোরবানি হয়েছিল। পরবর্তীতে যদি কোরবানির জন্য একমাত্র দুম্বাকেই নির্ধারণ করা হয় তাহলে সেটা নিশ্চিত করা কষ্টসাধ্য হয়ে যেতে পারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. আতাউর রহমান মিয়াজী বিবিসি বাংলাকে বলেন, “মুস্তাহিদ বা কোরআন সুন্নাহ বিশারদরা অনেক গবেষণা করে কোরবানির জন্য ছয়টি পশুর নাম চূড়ান্ত করলেন। সেগুলো ছিল- উট, গরু, মহিষ, দুম্বা, ছাগল ও ভেড়া”।

তিনি জানান, ইসলামের নিয়ম অনুযায়ী উটের বয়স পাঁচ বছর, গরু ও মহিষের বয়স দুই বছর এবং ছাগল, দুম্বা ও ভেড়ার ক্ষেত্রে এক বছর বয়স।

অন্যদিকে, গরু, উট ও মহিষ শুধুমাত্র এ তিনটি পশু সর্বোচ্চ সাতটি ভাগে কোরবানি দেয়া যাবে বলেও বিধান রয়েছে ইসলামে।

ছাগল বা বকরি কোরবানির প্রথা থেকে তখন মূলত ঈদুল আযহা বকরি ঈদ নামেই পরিচিত ছিল।

ছবির উৎস, Sazzad Hossain/SOPA Images/LightRocket via Getty Images

‘বকরি ঈদ’, গরুতে বিধি নিষেধ

বাংলা অঞ্চলে কোরবানির ঈদ বা ঈদুল আজহা সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের তথ্য পাওয়া যায় ইতিহাসবিদদের লেখায়।

অনেক সাহিত্যেই বলা আছে, তখন ছাগল বা বকরি কোরবানির প্রথা থেকে তখন মূলত ঈদুল আযহা বকরি ঈদ নামেই পরিচিত ছিল।

লেখক আবুল মনসুর আহমদ তার আত্মজীবনীমূলক বই আত্নকথায় লিখেছেন- “দাদাজীর আমলে মোহররম পর্বে আমাদের বাড়িতে এত ধুম ধড়ক্কি হইলেও দুই ঈদে কিন্তু অমন বিশেষ কিছু হইত না। বকরিদে প্রথম প্রথম দুই-তিনটা ও পরে মাত্র একটা গরু কোরবানি হইত”।

তখনকার সময়ে ঈদ পালনের রীতি বা প্রচলন নিয়ে বাংলা সাহিত্যে নানা ধরনের তথ্য এসেছে। এর বেশিরভাগেই- সুলতানি, মুঘল কিংবা বৃটিশ শাসনামলে এই অঞ্চলে কোরবানির ঈদের কিছু চিত্র বোঝা যায়।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তাঁর আত্মজীবনী ‘কাল নিরবধি’তে লিখেছেন, ‘বকরিদের আমরা প্রতিবছর কুরবানি দিতাম না, মাঝে মাঝে তা বাদ পড়ত ভক্তির অভাবে অতটা নয়, যতটা সামর্থ্যের অভাবে। বড়রা চেষ্টা করতেন, পশু জবাই থেকে আমাদের আড়াল করতে। আমরা ছোটরা ততোধিক উৎসাহে ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে জবাই দেখে ফেলতাম। দেখার পরে কিন্তু অনেকক্ষণ বিষাদে মন ছেয়ে যেত। তবে শেষ পর্যন্ত এই বিষণ্নতা পেছনে ফেলে দেখা দিত কুরবানির গোশত খাওয়ার উৎসাহ।’

সেই সময়ে কোরবানির ইতিহাস নিয়ে যে সব তথ্য পাওয়া যায়, তাতে সে সময়ে বাংলা অঞ্চলে গরু কোরবানির প্রচলন না থাকার পেছনে নানা ব্যাখ্যাও পাওয়া যায় ইতিহাসের আলোচনায়।

ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন ‘বাংলাদেশের উৎসব’ নামক বইয়ে লিখেন- “আজকে আমরা ইদ-উল-আযহায় গরু কোরবানির অনায়াসে গরু কিনে এনে সহজেই কোরবানি দিয়ে ফেলি। আশি একশো দুরে থাকুক পঞ্চশ বছর আগেও তা তেমন সহজসাধ্য ছিল না। আজকের প্রজন্ম হয়ত অবাক হবে যে এ নিয়ে সুদীর্ঘ পঞ্চাশ বছর বিতর্ক চলেছে এবং কোরবানি বিশেষ করে গরু কোরবানি দেওয়ার অধিকার আমাদের বাপ দাদাদের লড়াই করে আদায় করতে হয়েছে।”

এই পরিস্থিতি কেন হয়েছিল সে প্রসঙ্গে অধ্যাপক মামুন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “বিভিন্ন জায়গায় যারা হিন্দু জমিদার ছিলেন, তারা গরু কোরবানি নিষিদ্ধ করা শুরু করলেন”।

“অন্যদিকে গরু বেশি প্রচলিত না থাকার আরেকটি কারণ ছিল আর্থিক দৈন্যতা। বাংলাদেশের মানুষের আর্থিক দৈন্যতা এতটাই প্রবল ছিল যে একটা গরু কিনে কোরবানি দেয়া তাদের পক্ষে খুব দুরুহ ছিল”।

ঢাকায় প্রতি বছর কোরবানির আগে জমে ওঠে পশুর হাট

ছবির উৎস, Getty Images

গরু কোরবানি প্রচলন শুরু কবে?

উপমহাদেশের ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় মুঘল সাম্রাজ্যের সময়ও এই অঞ্চলে গরু কোরবানি খুব একটা প্রচলিত ছিল না।

ইসলামি ইতিহাসবিদরা বলছেন, মুঘল আমলে এই অঞ্চলে অনেক হিন্দু জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল। যে কারণে মুঘল সম্রাট আকবরের সময়েও গরু কোরবানিতে নানা বিধি নিষেধের বিষয়গুলো চলে আসে।

অধ্যাপক আতাউর রহমান মিয়াজী বিবিসি বাংলাকে বলেন, “মুঘল আমলে আকবর যখন সম্রাট হলেন। দীনে এলাহী যখন প্রচলিত হলো ওই সময়ে ঐতিহাসিক আবুল ফজলসহ অনেকে পরামর্শ দিলেন গরুটা যেন জবেহ করা না হয়”।

“কারণ ওই সময়ে এ অঞ্চলে ৯৫ শতাংশই হিন্দুদের বসবাস ছিল। সঙ্গত কারণে এটা জবাই করা মানে হিন্দুদের অনুভূতিতে আঘাত দেয়া। এটা কোরবানি করলে তখন সাধারণ হিন্দুদের মনে একটা ধর্মীয় অনুভূতির ক্ষেত্রে বিরূপ চিন্তা আসবে”।

ইতিহাসবিদরা বলছেন, সে সময় গরু কোরবানি নিষিদ্ধ না হলেও কম কোরবানি দেয়ার বিষয়ে উৎসাহিত করা হতো।

বাংলা অঞ্চলে গরু কোরবানি কবে থেকে বিস্তর লাভ করলো তার একটা ধারণা পাওয়া যায় ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের লেখায়।

তার মতে, উনিশ শতকের শেষ প্রান্তে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে গরু কোরবানি দেয়ার প্রচলন শুরু হয়। তবে যেসব জায়গায় যারা হিন্দু জমিদার ছিলেন সেখানে এটা বেশ কষ্টসাধ্য ছিল।

অধ্যাপক মামুন বলেন, ১৯৪০ এর দিকে গরু কোরবানিটা বেশি শুরু হয়। তখন এ অঞ্চলের পাট চাষিদের হাতে কিছু টাকা আসতে শুরু করলো। তখন কিছু কিছু জায়গায় নিজেদের স্ট্যাটাস দেখানোর জন্যও গরু কোরবানি দেয়া শুরু হলো”।

বিবিসি বাংলার অন্যান্য খবর
পশু উৎসর্গের রীতি প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন সমাজে ছিল।

ছবির উৎস, Getty Images

কোরবানির একাল-সেকাল

এক সময় এই অঞ্চলে কোরবানির ঈদে গরু জবাইয়ে কড়াকড়ি থাকলেও আস্তে আস্তে সে চিত্র পাল্টাতে থাকে বলে বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন গল্প প্রবন্ধে উঠে এসেছে।

১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পরই আস্তে আস্তে গরু কোরবানির পরিমাণ বাড়তে থাকে। তখন কোরবানির আমেজ বেশি ছিল পুরানো ঢাকায়।

তখন ঢাকায় কোরবানির ঈদের আগে কিছু কিছু জায়গায় গরু ছাগলের হাট বসতো। তখনকার বিখ্যাত একটি হাট ছিল রহমতগঞ্জের গণি মিয়ার হাট।

এই হাটে মুন্সিগঞ্জের মিরকাদিম থেকে আসা গরু ছিল খুব প্রসিদ্ধ। পুরনো ঢাকার জমিদার বা বনেদি পরিবারের লোকজন এই হাট থেকে গরু কিনতেন বলে ইতিহাসের বিভিন্ন বইয়ে উল্লেখ রয়েছে।

তখন ঢাকার লোকসংখ্যা কম ছিল। ঈদুল আজহার আগে গণি মিয়ার হাট ছাড়াও গাবতলী, সোয়ারীঘাট ও জিঞ্জিরায় গরুর হাট থেকে অনেকে গরু কিনতেন।

শিল্পপতি আনোয়ার হোসেন ‘আমার সাত দশক’ বইয়ে লিখেছেন, “ঈদের তিন চার দিন আগে থেকে দাবড়ে বেড়াতাম পুরো মহল্লায়, কে কত বড় আর সুন্দর গরু কিনল, দেখার জন্য”।

ইতিহাসবিদদের মতে, ১৯৫০ এর দশকে ঢাকায় স্বাভাবিক আকারের একটি গরুর দাম ছিল ৩০ থেকে থেকে ৫০ টাকা।

ইসলামের বিধান অনুযায়ী, কোরবানির ঈদের দিন থেকে শুরু করে তিনদিন পর্যন্ত পশু জবাই করা যায়। তখন পুরনো ঢাকার অনেক পরিবার ঈদের পরের দিন কিংবা তার পরের দিনও অনেকে গরু কোরবানি করতেন।

ইতিহাসবিদরা বলছেন, তখন ঢাকা ও আশপাশে কিছু হাট থাকলেও এটি গ্রামাঞ্চল ও দেশের বিভিন্ন জায়গায় তেমন ছিল না।

অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “গ্রামাঞ্চলে দরিদ্র লোকের বসবাস বেশি ছিল। সেখানে গরু কোরবানি খুব কম হতো। তবে শহরাঞ্চলে এটা বেশি ছিল। কারণ মধ্যবিত্ত চাকুরীজীবীদের স্থান ছিল শহর। ফলে গ্রামের চেয়ে শহরে বেশি ছিল”।

ইতিহাসবিদদের মতে, পরে আস্তে আস্তে ঢাকাসহ সারাদেশে গরু কোরবানি বাড়তে শুরু করে। স্বাধীন বাংলাদেশে একটু একটু করে পরিসর বাড়তে শুরু করেছে।

এখন ঢাকাসহ সারাদেশে অসংখ্য হাট বসছে। এসব হাটে গরুর পাশাপাশি ছাগল, ভেড়া এমনকি উটও পাওয়া যাচ্ছে।

এসব হাটগুলোতে বড় বড় গরু বিক্রি হয়। বিক্রির আগে এসব হাটে গরুর নাম দেয়া হয়- বাহাদুর, সম্রাট, লালু, কালুসহ বিভিন্ন নায়ক নায়িকা কিংবা সেলিব্রেটিদের নামে।