Home LATEST NEWS bangla সর্বশেষ সংবাদ ভূমিকম্পের পরে মিয়ানমারের মান্দালয়ে গোপনে গিয়ে যা দেখল বিবিসি

ভূমিকম্পের পরে মিয়ানমারের মান্দালয়ে গোপনে গিয়ে যা দেখল বিবিসি

5
0

Source : BBC NEWS

মান্দালয় শহরে যা দেখল বিবিসি

সতর্কতা: এই প্রতিবেদনের কিছু অংশ পাঠককে বিচলিত করতে পারে

মিয়ানমারে সাম্প্রতিক ভূমিকম্প যে ধ্বংসলীলা চালিয়েছে মান্দালয়ের রাস্তা-ঘাটে তার ভয়াবহ ছবি ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে।

শহরটির যে গলিতেই আমরা গিয়েছি, বিশেষ করে উত্তর আর মধ্য অঞ্চলে, সেখানেই ক্ষতিগ্রস্ত ভবন চোখে পড়েছে।অনেকগুলো বাড়ি তো একেবারে ধসে পড়েছে।

যতগুলো বাড়ি দেখেছি আমরা, প্রতিটির দেয়ালে অন্তত একটা করে ফাটল নজরে এসেছে। ওই সব বাড়িগুলোর ভেতরে প্রবেশ করা খুবই বিপজ্জনক ছিল।

শহরের প্রধান হাসপাতালটিতে আহতদের চিকিৎসা করা হচ্ছে খোলা আকাশের নিচে।

এখানে জানিয়ে দেওয়া দরকার, দেশটির সেনা সরকার ঘোষণা করে দিয়েছিল যে, ভূমিকম্পের খবরাখবর নিতে কোনও বিদেশী সাংবাদিককে মিয়ানমারে প্রবেশের অনুমতি দেবে না তারা।

সেজন্য বিবিসি ছদ্মবেশে সেদেশে গিয়ে অনেক সতর্কতা অবলম্বন করে এই প্রতিবেদনের জন্য খবর জোগাড় করেছে। দিকে দিকে গুপ্তচর আর গোয়েন্দারা ছড়িয়ে ছিলেন সাধারণ মানুষের ওপরে নজর রাখার জন্য।

আমাদের নজরে এসেছে এই ধ্বংসলীলার পরেও সাধারণ মানুষ খুবই কম সহায়তা পাচ্ছেন।

বিবিসি বাংলায় আরও পড়তে পারেন
ছেলের অপেক্ষায় নান সিন হেন

ছেলের অপেক্ষায় বসে আছেন মা

“আমি তো এখনও আশা করে আছি যে, ও বেঁচে আছে, যদিও জানি যে সেই সম্ভাবনা খুবই কম,” বলছিলেন ৪১ বছর বয়সী নান সিন হেন।

একটা ভেঙ্গে পড়া পাঁচতলা বাড়ির সামনে নিজের ছেলের জন্য গত প্রায় এক সপ্তাহ ধরে অপেক্ষা করছেন তিনি।

তার ছেলে, ২১ বছর বয়সের সাই হান ফা ওই ভবনে নির্মাণ শ্রমিক হিসাবে কাজ করছিলেন। এই ভবনটিতে আগে একটা হোটেল ছিল, সেটিকে একটা অফিস ভবনে পরিবর্তন করা হচ্ছিল।

নান সিন বলছিলেন, “ওকে যদি আজকেও বের করে নিয়ে আসা যায়, তবুও ওর বেঁচে থাকার একটু আশা আছে।”

তার ছেলে যে বাড়িটিতে কাজ করছিলেন, সেটির নিচের অংশটা ধসে পড়েছে আর ওপরের অংশটা রাস্তার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। দেখে মনে হচ্ছে যে কোনো সময় বাড়িটা ভেঙ্গে পড়বে।

সাই হানের সঙ্গে আরও চারজন শ্রমিক ওই ভবনের ভেতরে আটকে আছেন।

মান্দালয়ের রাস্তায়

উদ্ধারকাজ কীভাবে চলছে?

আমরা যখন ওই ভবনটির সামনে পৌঁছালাম, তখনও পর্যন্ত উদ্ধার কাজ শুরুই হয় নি, কবে শুরু হবে, তাও অজানা।

দেশটির যা রাজনৈতিক পরিস্থিতি, তার ফলেই সাধারণ মানুষের কাছে সহায়তা একেবারেই পৌঁছচ্ছে না।

ভূমিকম্পের আগে থেকেই মিয়ানমারে উথাল পাথাল চলছিল। গৃহযুদ্ধের ফলে আগেই প্রায় ৩৫ লক্ষ মানুষ গৃহহীন হয়ে রয়েছেন। আবার এই সঙ্কটজনক পরিস্থিতির মধ্যেও মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ‘বিদ্রোহী’ গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।

আর এর ফলেই নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যরা উদ্ধার কাজে খুব একটা সাহায্য করতে পারছেন না।

মান্দালয়ের যত এলাকায় আমরা ঘুরেছি, হাতে গোনা কয়েকটা জায়গা বাদ দিলে কোথাও সেনা সদস্যদের দেখা যায় নি।

আন্তর্জাতিক সহায়তার জন্য সেনা-সরকার একটা মৃদু আবেদন জানিয়েছিল, কিন্তু যুক্তরাজ্য বা যুক্তরাষ্ট্র সহ কোনও দেশই উত্তেজনাকর পরিস্থিতির কারণে এগিয়ে আসে নি। তবে সহায়তা পাঠানোর আশ্বাস অনেক দেশই দিয়েছিল।

বর্তমানে ভারত, চীন, রাশিয়া সহ কয়েকটি দেশের উদ্ধার-কর্মীরাই মিয়ানমারে কাজ করছেন।

যেসব ভবনে অনেক বেশি সংখ্যক মানুষের আটকে থাকার সম্ভাবনা আছে, সেগুলোতেই উদ্ধারকাজ চলছে। যেমন স্কাই ভিলা কন্ডোমিনিয়াম কমপ্লেক্সে। সেখানে এক সময়ে হাজার হাজার মানুষের বসবাস ছিল, বা ইউ হা থিন বৌদ্ধ একাডেমি যেখানে- ভূমিকম্পের সময়ে অনেক বৌদ্ধ ভিক্ষু পরীক্ষা দিচ্ছিলেন।

ভারতের উদ্ধারকারী দল কাজ করছে সেখানে

বৌদ্ধ অ্যাকাডেমিতে উদ্ধার অভিযানের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ভারতের বিপর্যয় মোকাবিলা দলের প্রধান নীরজ সিং।

তিনি বিবিসিকে বলছিলেন, যে ভবনটি “প্যান কেক” এর মতো একের পর এক স্তরে ভেঙ্গে পড়েছিল।

তার কথায়, “যেভাবে ভবনটি ধসে পড়েছে তাতে জীবিত কাউকে খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা কম। তারপরও আমরা আশাবাদী এবং যথাসম্ভব চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”

প্রখর রোদ ও ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে উপেক্ষা করে উদ্ধারকারীরা কংক্রিটের বড় বড় অংশকে ছোট ছোট টুকরো করতে ড্রিল ও কাটার ব্যবহার করছিলেন।

এটা খুবই পরিশ্রমের কাজ।

ক্রেন দিয়ে কংক্রিট সরাতেই মৃতদেহের তীব্র দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল। ওই গন্ধ সহ্য করা কঠিন।

উদ্ধারকারীরা চার-পাঁচটি মৃতদেহ দেখতে পেলেন। একেকটি মৃতদেহ উদ্ধার করতেই কয়েক ঘণ্টা সময় লেগে গেল।

পরিজনের দেহের জন্য অপেক্ষায় মানুষ

পরিজনদের দেহের অপেক্ষায় মানুষ

বৌদ্ধ একাডেমি প্রাঙ্গণে অস্থায়ী তাঁবুর নিচে মাদুর বিছিয়ে বসেছিলেন সেখানকার ছাত্রদের পরিবারের সদস্যরা। তাদের চেহারাতে উদ্বেগের ছাপ স্পষ্ট।

যখনই কোনও মৃতদেহ উদ্ধারের খবর পাচ্ছেন তারা, তখনই অ্যাম্বুলেন্সের দিকে ছুটে যাচ্ছেন।

এক উদ্ধারকারী নিজের মোবাইল ফোনে মৃতদেহের ছবি দেখাচ্ছেন, তার চারপাশে বেশ কয়েকজনের ভিড়।

পরিবারগুলির জন্য এ এক কঠিন সময়।

তারা মন দিয়ে ছবিটা দেখে বোঝার চেষ্টা করছিলেন যে দেহটি তাদের পরিবারের নিখোঁজ সদস্যেরই কী না।

তবে দেহটি এতটাই বিকৃত হয়ে গেছে যে তা শনাক্ত করা সম্ভব হল না।

অবশেষে মৃতদেহটি মর্গে পাঠানো হয়, যেখানে ফরেনসিক পরীক্ষার মাধ্যমে তা শনাক্ত করা হবে।

এই পরিবারগুলির মধ্যে আছে ২৯ বছর বয়সী ইউ থুজানার বাবা। এখন আর ছেলের জীবিত থাকার কোনো আশা নেই তার।

ইউ হ্লা আঙ্গ কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “আমার ছেলেরও হয়ত এমনই পরিণতি হয়েছে! আমি বিধ্বস্ত!”

ক্ষতি হয়েছে অনেক ঐতিহাসিক স্থানও

ঐতিহাসিক স্থানগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত

মান্দালয়ের বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক স্থানেও ক্ষতি হয়েছে, যার মধ্যে সেখানকার মহল ও মহামুনি প্যাগোডাও আছে। তবে সেগুলোতে ঠিক কতটা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, সেটা আমরা স্বচক্ষে দেখতে পারি নি।

ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে যাওয়া, মানুষের সঙ্গে কথা বলা সহজ ছিল না আমাদের পক্ষে। সেনা সরকারের ভয়ের কারণে মানুষ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে দ্বিধা করছিলেন।

প্যাগোডার কাছে একটি ধসে পড়া ভবনের বাইরে এক বৌদ্ধ দম্পতিকে দাহ করতে দেখেছি আমরা।

বাড়িটি ছিল ইউ হ্লা অং খাইং এবং তার স্ত্রী দাও মামার্থের। দুজনেরই বয়স ছিল ৬০ বছরের ওপরে।

তাদের পুত্র আমাদের বলেন, “আমি ওদের সঙ্গেই থাকতাম, কিন্তু ভূমিকম্পের সময় আমি বাইরে ছিলাম, তাই বেঁচে গেছি। আমি আমার বাবা-মাকে এক মুহুর্তের মধ্যে হারালাম।”

প্রশিক্ষিত উদ্ধার-কর্মীরা নয়, স্থানীয়রাই ধ্বংসস্তুপ থেকে তার বাবা মায়ের দেহ বার করেছেন দুই দিন ধরে।

ঘর হারিয়ে এখন আবর্জনার স্তুপের পাশে থাকছেন দাও খিন সাও মিন্ট,  সঙ্গে তার নাতনি

সাধারণ মানুষকে সাহায্য করার কেউ নেই

মিয়ানমারের সামরিক সরকারের হিসাব অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত ২ হাজার ৮৮৬ জন নিহত হয়েছেন ভূমিকম্পে। কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রশাসনের উদ্ধারকারী দল অনেক জায়গায় পৌঁছতেই পারেনি, তাই মৃতের সংখ্যাটা কতটা সঠিক তা বলা কঠিন।

ভূমিকম্পে কত মানুষ মারা গেছেন, তা হয়তো আমরা কখনোই জানতে পারবো না।

মান্দালয়ের পার্ক এবং খোলা মাঠগুলো এখন অস্থায়ী শিবিরে রূপান্তরিত হয়েছে। মহলের চারপাশে পরিখার ধার দিয়ে তাঁবুতে বাস করতে বাধ্য হচ্ছেন মানুষ।

যে কোনো সময় বাড়ি ধসে পড়ার আশঙ্কায় শহরজুড়ে লোকজন বাড়ির বাইরে তোশক ও মাদুর বিছিয়ে ঘুমচ্ছেন।

মান্দালয়ের বাসিন্দাদের আতঙ্কটা অমূলক নয়, কারণ প্রতি রাতেই সেখানে বড় ধরনের ভূমিকম্প অনুভূত হচ্ছে।

তবে মানুষ যে শুধু ভয়ের কারণেই বাইরে ঘুমচ্ছেন, তা না, এছাড়া তাদের আর কোনও উপায় নেই। এই ভূমিকম্পে তাদের বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে গেছে।

আমর সঙ্গে দেখা হয়েছিল ৭২ বছর বয়সী দাও খিন সাও মিন্টের। তিনি পানীয় জল নেওয়ার লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন। সঙ্গে ছিল তাঁর ছোট নাতনিও।

“এখন আমি কিছুই ভাবতে পারছি না। ভূমিকম্পের মুহূর্তটির কথা মনে পড়লে আমার বুক কেঁপে উঠছে। আমরা কোনোমতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলাম, কিন্তু আমার বাড়িটা পুরোপুরি ধসে পড়েছে। এখন একটি গাছের নিচে বসবাস করছি। আসুন, একবার দেখে যান,” বলছিলেন তিনি।

দাও খিন কাপড় ধোয়ার কাজ করেন, এবং তার পুত্র প্রতিবন্ধী।

“আমি এখন কোথায় যাব? একটা আবর্জনার স্তূপের পাশে থাকছি আমরা। কয়েকজন মানুষ আমাকে চাল আর কিছু কাপড় দিয়েছে। বাড়ি থেকে পালানোর সময়ে আমরা যে পোশাক পরেছিলাম, এখনও সেটাই পরে আছি,” বলছিলেন দাও খিন।

“কেউ আমাদের বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি। দয়া করে আমাদের সাহায্য করুন,” এই বলেই তিনি কাঁদতে শুরু করলেন।

পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আরেক বয়স্ক নারীরও চোখে জল। বলছিলেন, “আজ এখনও পর্যন্ত কেউ খাবার দিয়ে যায় না, সকাল থেকে আমরা সবাই খালি পেটেই আছি।”

আমরা দেখতে পেয়েছি যে ছোট ছোট ভ্যানে করে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে। তবে সেগুলোতে খুবই কম পরিমাণে ত্রাণ সামগ্রী ছিল। স্থানীয় কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এসব ত্রাণ সামগ্রী পাঠানো হয়। কিন্তু এত বেশি মানুষের সহায়তা দরকার যে ওই পরিমাণ ত্রাণ একেবারেই যথেষ্ট নয়। তাই ত্রাণ এলেই কাড়াকাড়ি পরে যায়।

মান্দালয়ের প্রধান হাসপাতালের ছবি

মান্দালয়ের প্রধান হাসপাতালে যা দেখল বিবিসি

মান্দালয়ের প্রধান হাসপাতালের কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তবে সেটির অবস্থা আগে থেকেই খারাপ ছিল আর এখন তো রোগীদের হাসপাতালের বাইরে বিছানা পেতে রাখা হয়েছে।

মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়েছিল ১৪ বছর বয়সী শোয়ে গে থুন ফিয়ো। তার চোখ দুটো লাল হয়ে ছিল। তার জ্ঞান ছিল, কিন্তু কোনো কথাতেই সাড়া দিচ্ছিল না। তার বাবা তাকে আরাম দিতে চেষ্টা করছিলেন। হাসপাতালে চিকিৎসক ও নার্সের সংখ্যা হাতে গোনা, তাই রোগীদের দেখভাল করছেন তাঁদের পরিবারের সদস্যরাই।

পেটে গুরুতর আঘাত পেয়েছিলেন জার।তার পেট ফুলে গিয়েছিল। তার মেয়ে পাশে বসে হাত পাখা দিয়ে হাওয়া দিচ্ছিলেন।

আমরা বেশিক্ষণ হাসপাতালে থাকতে পারিনি কারণ পুলিশ বা সেনাবাহিনী আমাদের ধরে ফেলতে পারে, এই ভয় ছিল।

এখন উদ্ধারকাজ ধীরে ধীরে শেষ হয়ে আসায় আহতদের বদলে হাসপাতালে মৃতদেহই বেশি আনা হচ্ছে।

ধসে পড়া একটা ভবনে তার ছেলে আটকা পড়ে আছে বলে সেটির সামনে অপেক্ষায় ছিলেন নান সিন হেন। গোড়ায় তাকে শান্ত দেখালেও এখন তার চোখে-মুখে যন্ত্রণা আর আতঙ্ক স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

“আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছে। আমাকে আর তার ছোট বোনদের খুব ভালোবাসতো আমার ছেলে। আমাদের যত্ন নেওয়ার জন্যই দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করত সে,” বলছিলেন নান সিন।

তিনি বলছিলেন, “এখন আমি শুধু একবার আমার ছেলের মুখটা দেখতে চাই, যদিও জানি সে আর নেই। আমি তার মৃতদেহটা একবার দেখতে চাই। ওর দেহটা খুঁজে বের করার জন্য ওরা যতদূর সম্ভব চেষ্টা করুক।”