ঈদের ছুটি এগিয়ে আনার পরও মহাসড়কে তীব্র যানজট কেন?

ঈদুল আযহা উপলক্ষে এবার ১০ দিনের ছুটি দিয়েছে সরকার। দূর-দূরান্তের গন্তব্যে আসা-যাওয়ায় ঝক্কি-ঝামেলা যাতে কম হয়, সেবিষয়টি লক্ষ্য রেখেও এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। তবে কিছু মহাসড়কে গত দুই দিন ধরে তীব্র যানজটের খবর পাওয়া যাচ্ছে।

ঈদুল আযহা উদযাপিত হবে আগামীকাল ৭ই জুন। তবে ঈদের আগে শেষ কর্মদিবস ছিল গত বুধবার। মূলত এরপর থেকেই ঢাকা থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে যানবহনে ধীরগতির খবর আসতে শুরু করে।

বৃহস্পতি ও শুক্রবার ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গ ও ময়মনসিংহের পথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজট তৈরি হয়।

রাতভর যানবাহনগুলো মহাসড়কে থেমে থেমে ধীরগতিতে চললেও ভোর থেকে চাপ বেড়ে যায় কয়েকগুণ।

বিশেষ করে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গী, গাজীপুর চৌরাস্তা, বোর্ডবাজার এলাকা সেইসাথে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজট দেখা গেছে। যাত্রীবাহী যানের পাশাপাশি আটকা পড়েছে পশুবাহী গাড়িও।

এভাবে একসাথে শত শত যানবাহন আটকা পড়ায় ভোগান্তিতে পড়েছে শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সী যাত্রীরা।

ছুটির শুরুতেই এমন চরম ভোগান্তি যেন ঈদের আনন্দকে ম্লান করে দিচ্ছে বলে মনে করছেন যাত্রীদের অনেকে।

বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত ঢাকা-টাঙ্গাইল-যমুনা সেতু মহাসড়কের অন্তত ২৫ থেকে ৩০ কিলোমিটার এলাকায় থেমে থেমে যানজটের সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছে হাইওয়ে পুলিশ।

বিশেষ করে রাবনা বাইপাস থেকে যমুনা সেতু পর্যন্ত অন্যদিকে যমুনা সেতুর পূর্বপ্রান্ত থেকে আশেকপুর বাইপাস পর্যন্ত সেইসাথে মহাসড়কের সেতু এলাকা থেকে করটিয়া করাতিপাড়া বাইপাস পর্যন্ত দীর্ঘ সময় যান চলাচল ব্যাহত হয়ে পড়ে।

হাইওয়ে পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, মূলত সড়কে একাধিক গাড়ি বিকল হয়ে পড়া, ছোটখাটো দুর্ঘটনা ও ঈদের আগ মুহূর্তে অতিরিক্ত যানবাহনের চাপে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

যানজট আজকে সন্ধ্যার পর থেকে নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে বলে আশা প্রকাশ করেছে হাইওয়ে পুলিশ।

আজ শুক্রবারও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে গাজীপুর শহরের কোনাবাড়ী থেকে মির্জাপুরের গড়াই পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকায় গাড়ি ধীরে ধীরে চলেছে।

ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গী, গাজীপুর চৌরাস্তা সেইসাথে বোর্ডবাজার থেকে সালনা পর্যন্ত এবং চন্দ্রা মোড় এলাকায় গাড়ি থেমে থেমে চলছে। গাবতলী থেকে হেমায়েতপুর এলাকায় ধীরগতিও দেখা গেছে।

এলেঙ্গা হাইওয়ে ফাঁড়ির ইনচার্জ মোহাম্মদ শরীফ বিবিসি বাংলাকে জানান, “মহাসড়কে ফিটনেসবিহীন যানবাহন বিকল হওয়ায় এবং কয়েকটি গাড়ি দুর্ঘটনার কবলে পড়ায় মহাসড়কে মানুষকে এই ভোগান্তির মুখে পড়তে হয়েছে।”

“যখন যমুনা সেতুর ওপর গাড়ি বিকল হয়ে যায় তখন সেটা রেকার দিয়ে সরিয়ে নিতে অনেক সময় লাগে। তাছাড়া সেতুর একটা ক্যাপাসিটি আছে। একসাথে অনেক মানুষ ভিড় করায় সেটা সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়েছে,” তিনি বলেন।

যাত্রীবাহী বাস ছাড়াও ট্রাক, পিকআপ, বিভিন্ন সড়কের লোকাল বাস, লেগুনায় যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে। মহাসড়কে বাসের চেয়ে ট্রাক ও পিকআপ বেশি দেখা যাচ্ছে।

সেতু কর্তৃপক্ষ জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনা সেতু দিয়ে পার হয়েছে প্রায় ৬৫ হাজার যানবাহন। এতে করে টোল আদায় হয়েছে প্রায় চার কোটি ১৯ লাখ টাকা। সেতু চালু হওয়ার পর এটাই একদিনে সর্বোচ্চ টোল আদায়ের রেকর্ড।

অতিরিক্ত যানজটের কারণে আগে যেখানে গন্তব্যে পৌঁছাতে দুই থেকে তিন ঘণ্টা সময় লাগার কথা সেখানে দশ ঘণ্টাতেও পৌঁছাতে পারছে না সাধারণ মানুষ।

ঢাকা থেকে গৃহিনী ফারহানা সুলতানা দুই শিশুসহ ব্যক্তিগত গাড়িতে করে ঢাকার কাঁটাবন এলাকা থেকে ময়মনসিংহের উদ্দেশে রওনা হন।

অন্যান্য সময় তার এই দূরত্ব পাড়ি দিতে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা সময় লাগলেও এবারে তার সময় লেগেছে ১১ ঘণ্টারও বেশি।

“আমি রাস্তার ভোগান্তি এড়াতে ব্যক্তিগত গাড়ি ভাড়া করেছিলাম। সেখানে আমার এতো সময় লেগেছে। দুটো বাচ্চাকে এতোটা সময় নিয়ে রাস্তায় থাকাটা কতোটা ভোগান্তির সেটা যার সাথে না হয় সে বুঝবে না। যারা বাসে করে যাচ্ছেন তাদের কী অবস্থা সেটা ভাবতেও পারছি না,” বিবিস বাংলাকে বলেন তিনি।

এতো দীর্ঘ সময় সড়কে আটকে থাকার কারণে ব্যাপক ভোগান্তির মুখে পড়তে হচ্ছে ফারহানার মতো অসংখ্য সাধারণ যাত্রীদের। এ অবস্থায় মহাসড়কে ট্র্যাফিক ব্যবস্থাপনায় আরও নজরদারির প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।

তবে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, মহাসড়কে পর্যাপ্ত পরিমাণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন রয়েছে।

ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে পুলিশ ও সেনাবাহিনী যৌথভাবে যানজট নিরসনে কাজ করছে এবং ইতোমধ্যে তারা ঢাকাগামী গাড়িগুলোকে ভুয়াপুর বাইপাস দিয়ে ঘুরিয়ে দিচ্ছে।

ঢাকা থেকে বরিশালগামী যাত্রীদের তীব্র যানজটের মুখে পড়ার কথা জানান ওই সড়কে চলাচলকারী সাধারণ যাত্রীরা।

বিশেষ করে পদ্মা সেতু টোল প্লাজায় এবং পদ্মা সেতু পার হবার পর যানজটের দীর্ঘ যানজটের মুখে পড়ার কথা জানান তারা।

বেসরকারি চাকরিজীবী রিফাত মাহমুদ জানান, ভাঙ্গা মোড়ের পর থেকে মহাসড়কে যত্রতত্র রিকশা, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা এবং হিউম্যান হলার চলায় বড় যানগুলোর ওই পথ পাড়ি দিতে বেশি সময় লাগছে।

এছাড়া ঢাকা থেকে বরিশাল যাওয়ার পথে বাটাজর, ভুরঘাটা, রহমতপুর ও গৌরনদীর পয়েন্টে সেইসাথে বরিশাল শহরে প্রবেশের আগে, গড়িয়ার পাড় থেকে কাশিপুর মোড় পর্যন্ত দীর্ঘ যানজটে পড়ার কথা গণমাধ্যমকে জানান সাধারণ যাত্রীরা।

পদ্মা সেতু দিয়ে ঢাকা-বরিশাল যাত্রায় সাধারণত সাড়ে তিন ঘণ্টা সময় লাগার কথা থাকলেও, যাত্রীরা ছয় থেকে সাত ঘণ্টাতেও গন্তব্যে পৌঁছাতে পারছেন না।

এদিকে বুধবার রাত ও বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই সদরঘাট, কমলাপুর, মহাখালী, গাবতলী ও সায়েদাবাদসহ বিভিন্ন বাস টার্মিনালে যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড় দেখা গেছে।

যাত্রীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও টিকিট পাচ্ছেন না। টিকিটের সংকটের পাশাপাশি স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ উঠেছে পরিবহন সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুক্তভোগী কয়েকজন যাত্রীর ভিডিওতে দেখা গিয়েছে অন্যান্য সময়ের চাইতে তাদের কাছ থেকে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ প্রায় ১০০ থেকে ২০০ টাকা বেশি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে।

টিকেট সংকট ও অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের কারণে অনেকেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে খোলা ট্রাক-পিকআপ ও বাসের ছাদে গন্তব্যে যেতে দেখা যাচ্ছে।

আবার অতিরিক্ত ভাড়া দিতে রাজি না হওয়ায় মহাখালী বাস টার্মিনালে এক যাত্রীকে মারধরের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।

এদিকে দক্ষিণাঞ্চলগামী যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়ার অভিযোগ আসায় আজ বৃহস্পতিবার সকালে ধোলাইপাড় এলাকার কিছু অস্থায়ী কাউন্টারে অভিযান পরিচালনা করেছে সেনাবাহিনী।